প্রাথমিকে ছুটি ও শ্রান্তি বিনোদন বৈষম্য কেন?
শিক্ষার্থীর স্বস্তি, বিনোদন, আনন্দ, বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপভোগ ও উদযাপনের নিমিত্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত বা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি তালিকা প্রণয়ন করে থাকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
পাকিস্তান আমল থেকে প্রাথমিকে ৭৫ দিন, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ৮৫ দিন ছুটি আজও বিদ্যমান। রোজা, ঈদ, বিভিন্ন ধর্মের উৎসব, জাতীয় ও বিশেষ দিবস, গ্রীষ্ম বা শীতকালীন অবকাশ ছুটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকে।
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে গ্রীষ্মের দাবদাহ বেড়েই চলছে। ফলে গরিবের মাঝে গরমের যন্ত্রণা সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি হয়। ধনিক শ্রেণির মানুষের বাড়ি, গাড়ি, অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই এসি লাগানো হয়। গরমের ভয়াবহতা তাদের কাছে ঘেঁষতে পারে না।
সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করে থাকে। রৌদ্রের প্রচণ্ড তাপের মাঝে তাদের অনেকেই হেঁটে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে। বিদ্যালয়ে সিলিং ফ্যান থাকলেও অনেক শিক্ষার্থী একসঙ্গে অবস্থান করে বিধায় তাপের তীব্রতা বেশি অনুভব হয়।
পাকিস্তান আমল থেকে গরমের সময় বিদ্যালয়ের সময়সূচি সকাল ৭টা থেকে শুরু করে ও খানিকটা সংক্ষিপ্ত করে রোদের প্রচণ্ড তাপের আগে বিদ্যালয় ছুটি হতো। এছাড়া গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিনের বেশি রাখা ছিল।
কিন্তু বর্তমানে সেগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেছে। নামমাত্র গ্রীষ্মের ছুটি দেয়া হয় ৪-৫ দিন। গ্রীষ্ম অবকাশের ছুটি কম থাকায় শুধু যে যন্ত্রণা শিক্ষার্থীর একার তা নয়, ভুক্তভোগী শিক্ষকদেরও। প্রতি বছরের মতো এবারেও গ্রীষ্ম অবকাশের ছুটিসহ ছুটির তালিকায় নানা অসঙ্গতি ছিল। তা সংশোধনের জন্য ২০ জানুয়ারি প্রতিমন্ত্রী বরাবর আবেদন করা হয়, যা প্রিন্ট, অনলাইন মিডিয়া, ফেসবুকে ব্যাপক প্রচার হয়। কিন্তু বিষয়টি প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সদয় দৃষ্টি কাড়তে ব্যর্থ হয়। ভাবখানা এমন, এ দেশের শিশু ও শিক্ষকদের কল্যাণের প্রতি তাদের কোনো দায় নেই। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের দায় সচিব বা মন্ত্রীর কাছে।
এভাবে সব দায় যেন সর্বশেষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া ছোটখাটো সমস্যাগুলোতেও যেন কারও কিছু করার নেই। বর্তমানে সারা দেশে শিক্ষকরা শ্রান্তি বিনোদনের ভাতা সরকারি বিধিমোতাবেক ৩ বছর পরপর প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে এক শিক্ষক নেতার মন্তব্য, ‘আমরা তো উচ্চবিদ্যালয়ের মতো ৮৫ দিন ছুটি দাবি করছি না। ৭৫ দিন ছুটির মধ্যে ১৫ দিন গ্রীষ্ম অবকাশ রেখে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা ৩ বছর পরপর প্রাপ্তির নিশ্চয়তা চেয়েছিলাম। প্রাথমিক শিক্ষকদের দীর্ঘ কয়েক বছরের যৌক্তিক আবেদনের প্রতি দৃষ্টি না দেয়া দুঃখজনক।’
গ্রীষ্ম অবকাশ নিয়ে প্রতিমন্ত্রী বরাবর আবেদনে উল্লেখ ছিল, ‘প্রাথমিক শিক্ষকরা সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার কর্মরত থাকায় তাদের ছুটি সরকারি কর্মচারীদের চেয়ে কম। সব সরকারি কর্মচারী শ্রান্তি বিনোদন ভাতা ১ মাসের মূল বেতনের সঙ্গে ১৫ দিনের বাড়তি ছুটি পান।
শ্রান্তি বিনোদন ভাতাপ্রাপ্তির জন্য প্রাথমিক শিক্ষকদের কারিগরি বিভাগের কর্মচারী দেখিয়ে ১৫ দিন ছুটি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সে কারণে প্রাথমিক শিক্ষকদের যে কোনো অবকাশে ১৫ দিন ছুটি দেখাতে হয়। বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও আলাদা গ্রীষ্ম অবকাশ বা অন্য কোনো অবকাশে ১৫ দিন ছুটি রাখা হয়নি।
বিগত বছরগুলোয় রমজান মাস থেকে ১৫ দিন শ্রান্তি বিনোদনের জন্য ছুটি দেখিয়ে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দফতরে বিল দাবি করা হয়। হিজরি সন ৩৫৫ দিন হওয়ায় ৩ বছরে রমজানের ছুটি ৩০ দিন এগিয়ে আসে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষকরা ৪-৫ বছর পর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পেয়ে আসছেন।
তাই রমজান মাস ছাড়া গ্রীষ্মের ছুটি বা অন্য অবকাশে ১৫ দিন ছুটি নির্ধারণ করার নিবেদন জানানো হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ও বিশেষ দিবসগুলোয় বিদ্যালয় খোলা রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অর্থবহ করার কথা উল্লেখ করা হয়। বিদ্যালয় খোলা রেখে জাতীয় ও বিশেষ দিবসগুলো পালন করা হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের উপস্থিতি থাকবে বাধ্যতামূলক।
শিক্ষার্থীরা জাতির সংগ্রামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবে। ওই ছুটি গ্রীষ্মের অবকাশের সঙ্গে যোগ করে ১৫ দিন ছুটি রাখার আবেদনে জানানো হয়। এতে প্রাথমিক শিক্ষকদের শ্রান্তি বিনোদন ভাতা সরকারি কর্মচারীদের মতো ৩ বছর পরপর প্রাপ্তি নিশ্চিত হতো।
দিনাজপুর সদরসহ বাংলাদেশের বহু স্থানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বহু প্রাথমিক শিক্ষক গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন নির্ধারণ না করার কারণে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষার্থীর স্বস্তি, আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণসহ শিক্ষকদের অধিকারপ্রাপ্তি থেকে দীর্ঘ সময় বঞ্চিত করার দায় কেন জবাবদিহিতার আওতায় আসছে না?
শিক্ষকদের সময়ানুবর্তিতা ও পাঠদানে অবহেলার বিষয় নিয়ে কি শুধু জবাবদিহিতা থাকবে? তাদের অধিকার নিয়ে উদাসীনতার কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না? বৈষম্যে চরম অবস্থায় আজ প্রাথমিক শিক্ষা জর্জরিত।
কেবল সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড ও প্রধান শিক্ষকদের ১০তম গ্রেড নয়, গ্রীষ্মের গরমে শিশু শিক্ষার্থীদের কষ্ট দেয়া, শিক্ষকদের শ্রান্তি বিনোদন ভাতা যথাসময়ে প্রাপ্তির নিশ্চয়তাসহ সব শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন কর্মঘণ্টা, পাঠ্যবই, মূল্যায়ন পদ্ধতি ব্যবস্থার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নীরবতা স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষাবান্ধব সরকারের আমলে মেনে নিতে কষ্ট হয়।
প্রতিমন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে স্বীয় দায়িত্ব অবহেলা বা উদাসীনতা পরিহার করে দ্রুত সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: মো. সিদ্দিকুর রহমান
আহ্বায়ক: বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ এবং প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম