সরকারি চাকরিতে বয়স বাধা হতে পারে না
বর্তমান সময়ে আলোচিত বিষয় সরকারি বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করা না করা নিয়ে পক্ষ বিপক্ষের জোর বিতর্ক যুক্তি ও আন্দোলন। এ দাবির পক্ষে বিগত অর্ধযুগ ধরে শান্তিপূর্ণ উপায়ে একটি আন্দোলনের প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছে। তারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ এর উপরে। শুধু বাংলাদেশ ও দু’একটি দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ বেঁধে রাখা হয়েছে।
আন্দোলনকারীদের যুক্তি বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাও বাড়ানো হয়েছে। আবার কখনো চাকরিতে অবসরের বয়সও বাড়ানো হয়েছে। উপরিউক্ত প্রেক্ষিতে তাদের পক্ষ থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার জোর দাবি জানানো হচ্ছে।
এছাড়া একাডেমিক পড়াশোনা শেষ করতে বেশি সময়, সেশন জটিলতা, চাকরির ফল ও নিয়োগে দীর্ঘসূত্রিতাসহ বহুবিধ কারণে তারা চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে চিন্তা ভাবনা করেছে। একাধিক মন্ত্রী এমপি এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্পীকার থাকাবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতেও তিনবার বয়স বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছিল।
সর্বশেষ চলতি বছরের জাতীয় সংসদে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপিত হলে কণ্ঠ ভোটে তা নাকচ হয়ে যায়। এতে করে আন্দোলন কারীরা হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং নতুন করে আন্দোলনের ডাক দেয়। এ আন্দোলনের কারণে এবারে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দু’দফায় সরকারি চাকরিতে বয়স বাড়ানোর দাবি নাকচ করে দিয়ে বয়স বাড়ানোর বিরুদ্ধে বেশ কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন।
পড়ুন: চাকরিতে প্রবেশের বয়স কেন ৩৫ করতে হবে?
চীন থেকে দেশে ফেরে সাংবাদিক সন্মেলনেও গতকাল জাতীয় সংসদের একই তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। বিগত তিনটি বিসিএস পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণদের চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে তিনি বলেন, ৩৫তম বিসিএস এ যাদের বয়স ২৩ থেকে ২৫ তারা উত্তীর্ণ হয়েছে ৪০.৭ ভাগ আর যাদের বয়স ২৫ থেকে ২৭ তাদের উত্তীর্ণের ভাগ হচ্ছে ৩০.২৯। ২৭ থেকে ২৯ যাদের বয়স তাদের উত্তীর্ণের হার হচ্ছে ১৩.১ শতাংশ আর ২৯ বছরের উপরে যারা পরীক্ষা দিয়েছে তাদের পাশের হার হচ্ছে ৩.৪৫ ভাগ।
একইভাবে ৩৬তম বিসিএসের রেজাল্টের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। ৩৬তম বিসিএসে ২৩ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে যারা পরীক্ষা দিয়েছে তাদের পাসের হার ৩৭.৪৫ ভাগ। ২৫ থেকে ২৭ বছর বয়সীদের পাসের হার ৩৪.৭৮ শতাংশ। ২৭ থেকে ২৯ বছর বয়সী যারা পরীক্ষা দিয়েছে তাদের পাসের হার ১৪.২৯ শতাংশ। ২৯ বছর বয়সের বেশি যারা পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা দিয়েছে তাদের পাসের হার ৩.২৩ শতাংশ।
সর্বশেষ ফল প্রকাশ হওয়া ৩৭তম বিসিএসের ফলাফল তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩৭তম বিসিএসে ২৩ থেকে ২৫ বছর বয়সে যারা পরীক্ষা দিয়েছিল পাসের হার ৪৩.৬৫ শতাংশ। ২৫ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে যারা পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাদের পাসের হার ২৩.৩৫ শতাংশ। ২৭ থেকে ২৯ বছর বয়সে যারা পরীক্ষা দিয়েছে তাদের পাসের হার ৭.২০ শতাংশ। আর ২৯ বছরের উপরে যারা পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাদের পাসের হার ০.৬১ শতাংশ।
দেখুন: বৃহৎ গণজমায়েতের প্রস্তুতি ৩৫ আন্দোলনকারীদের
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিসংখ্যানের আলোকে কিছু কথা বলি:
প্রথমত: সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য বর্তমানে চাকরি শুরুর বয়স ৩০ হলেও মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, উপজাতি কোটায় এই বয়স ৩২, নার্সের চাকরির জন্যে ৩৬ আর বিভাগীয় প্রার্থীর কোটায় ৩৫ বছর রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৩০ বছর হলেই যদি একজন যুবকের সব শেষ হয়ে যায় তাহলে এসব প্রবীণ বৃদ্ধদের নিয়ে কি করবেন? একই দেশে দুধরনের নিয়ম হয়ে গেল না?
দ্বিতীয়ত: ৩৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে দুই লাখ ৪৪ হাজার ১০৭, ৩৬তমতে দুই লাখ ১১ হাজার ৯১২,এবং ৩৭ তমতে ছিল দুই লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৬ জন আবেদন করেছিল। ৩৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে ৮.৩৫ শতাংশ, ৩৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে ৬.৫৪ শতাংশ পাস করেছিল। লিখিত পরীক্ষায় আগে ১০ শতাংশ কৃতকার্য হলেও এখন তা আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে। এখন তা ২.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ৩৫তম লিখিত পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে ২.৪৯ শতাংশ। বহু সংখ্যক পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এভাবে বয়স বের করলে প্রকৃতপক্ষে বিশাল সংখ্যক যুবক ও তারুণ্যের মেধাকে অস্বীকার করা হবে।
এই পরিসংখ্যান চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাকে রুদ্ধ করতে পারে না। কারণ তারা শুধু বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির আন্দোলন করছেন না। সকল সরকারি বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স তারা ৩৫ চান। নন ক্যাডার, সেকেন্ড ক্লাসের জব, প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক, হাইস্কুলের শিক্ষক নিয়োগসহ সকল প্রকার সরকারি নিয়োগে তারা প্রবেশের বয়স ৩৫ চান।
সুতরাং শুধু বিসিএসের পরিসংখ্যান দিয়ে ৩৫ এর দাবিকে অস্বীকার করা যায় না। তিনটি বিসিএসে আনুমানিক চার পাঁচ হাজার নিয়োগ পেয়েছে। চার পাঁচ হাজার দিয়ে কয়েক লক্ষ বেকার যুবকের ভাগ্য পরিসংখ্যান দিয়ে নির্ধারিত হতে পারে না।
তৃতীয়ত: চাকরিতে বয়স বৃদ্ধি করলে পেনশন দিতে সমস্যা। নীতিমালা আইন কি মানুষের জন্য না নীতিমালা ও আইনের জন্য মানুষ? যদি আইন নীতিমালা মানুষের জন্য হয়ে থেকে আমাদের চেতনার ৭২ এর সংবিধান ষোলবার সংশোধন হয়েছে। তা হয়েছে আপনাদের ও দেশের প্রয়োজনে। সুতরাং পেনশনের নিয়ম নীতিমালা দৈব কোনো বাণী নয় যে এর পরিবর্তন পরিবর্ধন সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সদিচ্ছা।
আরও দেখুন: অটল অধ্যাপক ফারুক, বললেন- ঢাবি দায়বদ্ধতা অনুভব করে বলেই দুধ গবেষণা
চতুর্থত: যদি বয়স বেশি হবার কারণে ৩০ এর বেশি বয়সধারীরা প্রতিযোগিতায় না টেকে তাতে তো কোনো সমস্যা নেই। তারা অন্য পথ ধরবে কিন্তু তাদের বঞ্চিত করে রাখা কি মৌলিক অধিকারের খর্ব নয়? সত্তর আশি বছরের কত প্রবীণ রাজনীতিবিদ রাষ্ট্র চালাচ্ছেন। সেখানে যুবকদের বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রেখে লাভ কি?
ওদের একটু সুযোগ দিলে হয়তো কিছু পরীক্ষার্থী বাড়বে একটু পরিশ্রমও আপনাদের বেশি হবে। আয় তো কমছে না। পিএসসি তো বেকারদের কাছ থেকে বেকার কর আদায়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।আমরা যারা বিভিন্ন পোস্ট পদবীতে বসে আছি আমরা ভাবি আমরা কখনো বেকার ছিলাম না? পরিশেষে একটিই দাবি ৩৫ যৌক্তিক দাবি যা কোনো যুক্তিতেই অস্বীকার করা যায় না। তারুণ্যের প্রাণের দাবি ৩৫ মেনে নেওয়া সময়ের দাবি। তারুণ্যের জয় হোক। ৩৫ এর জয় হোক।
[লেখক: শিক্ষক ও গবেষক]