আমার বাবা আমার পৃথিবী
বাবার জীবনটা অসম্ভব সাদা সিদে জীবন। প্রথম জীবনে একজন সফল কৃষক ছিলেন । মাঠে সোনা ফলানোই ছিল বাবার একমাত্র কাজ। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন ছিলেন বাবাই।
একজন সফল কৃষক হিসেবে বাবার বেশ নাম-দাম ও ছিল। মধ্য বয়সে সন্তান-সন্ততি আর পরিবারের ভাগ্য বদলে তিনি পাড়ি দেন মধ্যপ্রাচ্যে। তারপর রচিত হয় নতুন এক সংগ্রামের ইতিহাস। কোন এক কবি বলেছিলেন , এখনো বেশ বাকী তবুও কিছু বলি। কিছুটা বলি। বিদেশে কত যে সমস্যার মুখামুখি হয়েছেন তিনি, তাঁর সঠিক হিসেব জানিনি। ভিসা সংক্রান্ত সমস্যায় কত যে চোখের পানি ঝরেছে সেই পবিত্র ভূমিতে, তার হিসেব কেবল তিনিই জানেন। তারপর ভালো একটা চাকুরি ও পেয়েছিলেন।
দেশে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তিনি এই চাকুরীতেই নিয়োজিত ছিলেন। এখন বাবা জীবনের শেষ প্রান্তেই আছেন। সেদিন আমার প্রিয় ছোট ভাই সেবুল ইসলাম ( মায়ের দেয়া নাম, শানু নামে বেশ পরিচিত ) জিজ্ঞেস করেছিল, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কেমন আছেন ? তিনি বলেছিলেন, শুকরিয়া বেশ ভালো। দোয়া রইলো পৃথিবীর সব বাবারা যেন ভালো থাকেন। এই দিনে এই হোক মোদের প্রার্থনা।
অত্যন্ত সজ্জন হিসেবে বাবার পরিচিতির কমতি নেই। বাবার কথা বলতেই সবার মাঝে একজন আদর্শর , সৎ আর সরস-নিরস মানুষেরই প্রতিকৃতি চোখে ভাসে। তিনি জীবনে কাউকে কটু কথা বলেননি। সহ্য করেছেন কত যন্ত্রণা । অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা । মা গল্প করেছেন বাবার পরিশ্রমের কথা কিন্তু বাবার প্রাপ্তি ছিল শুণ্য । তাঁর পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘামের গন্ধ এখনো আমাদের অনুপ্রেরণা। আমার সব সময় মনে হয় যে, এলাকার মানুষের জন্য বাবার ছিল একবুক ভালোবাসা । তিনি অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন মানুষের কল্যাণের প্রতি। তাই বারবার সুখে-দুখে, বিপদে-আপদে, সংশয়-সংকটে এলাকার মানুষের কাছেই থাকতেন। মানুষ তাঁকে দেখে আশ্বস্থ হয়েছে, ভরসা পেয়েছে, আস্থা ও বিশ্বাস হারায়নি।
খুব কাছ থেকে বাবার চোখের পানি দেখেছি। তিনি পার্থিব বিষয়ে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসেব কষতেন আর কাঁদতেন। আমাদের সান্ত্বনা এড়িয়ে গোপনে শুধু কেঁদেছেন । জানি দুনিয়াতে এ কান্নার কোন দাম নেই কিন্তু আল্লাহর কাছে অনেক অনেক দাম। এ কান্না ছিল নেহাতই সন্তান সন্ততির জন্য। মা প্রায়ই বাবাকে সান্ত্বনা দিতেন আর বলতেন, আল্লাহর ঘর খালি নেই। সকল নাজ নেয়ামতের মালিক তিনিই। তিনি পরম দয়ালু সৃষ্টিকর্তা। তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁকে রাজত্ব দান করেন, যাকে ইচ্ছা তার কাছ থেকে রাজত্ব কেড়ে নেন। তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান ।
"অসমাপ্ত আত্মজীবনী" গ্রন্থে রবার্ট জেন্কিন্স কর্তৃক Poet of Politics খ্যাত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) উল্লেখ করেছেন " রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভাল হল। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী ।
লেখাপড়া তো মোটেই করি না। দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পাইনা। আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, "বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা , তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, 'Sincerity of purpose and honesty of purpose' থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না। এ কথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই। " বর্তমান প্রজন্মের কাছে এ বার্তাটুকু পৌঁছে দিয়ে বলি, 'রাজনীতির কবি'র দেখানো পথে বদলে যাই। এখনই বদলের শ্রেষ্ঠ সময়।
পৃথিবীর সব বাবারাও সততার কথা বলেন । ব্যতিক্রম খুবই কম। ধর্ম কর্মে প্রতি বাবার মনোযোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। ধার্মীক হিসেবে তিনি প্রথম সারির-ই। রোজ সকালে বাবার জিকিরে, কুরআন তেলাওয়াতের শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে , এখনো। খুব মনে পড়ে বাবা সব সময় নামাজের কথা বলতেন, এখনো বলেন। নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি, তিনি গুরুত্ব দিয়ে বলতেনও বেশি। কাজকে কম গুরুত্ব দেননি । তিনি বলেন, কাজে বড় হও, কথায় নয়। প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাসের মা কুসুমকুমারী দাসের কবিতা থেকে বলি-
"আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে’ – এই যার পণ ।"
পৃথিবীর সব বাবারা চান তাঁর ছেলেরা মানুষ হোক। চলুন এই দিনে আমরা মানত করি মানুষের মতো মানুষ হয়ে সব বাবাদের মুখে হাসি ফুটাবো।
আমার এই লেখা অপূর্নাঙ্গ, খণ্ডিত এবং অসমাপ্তও বটে। কিন্তু সে আমার অক্ষমতা । পৃথিবীসম এমন একজন বাবাকে পুরোপুরি বলা যায় এ ক্ষুদ্র লেখায়। আমার জানা নেই, তবুও। কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমার মনে হয় ,এমন বাবাদের আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে হবে। না, ঔচিত্য থেকে নয়, কর্তব্য কারনেও নয়, দায়িত্ববোধ থেকেও নয়- শুধু ভালোবাসার তাড়নায়, মমতার কারনে, আর হৃদয়ের তাগিদে। এই লেখা ওই তিনটিরই সমষ্টি আর কিছু নয়।
লেখক: গবেষক ও প্রভাষক, তাজপুর ডিগ্রী কলেজ, সিলেট।