ছুটিতো শেষ; পড়াশুনায় মন দাও
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘ছুটি’ কবিতা আমাদের প্রায় সকলেরই জানা। ছোটবেলায় আমরা অনেক মজা করা গানের তালে তালে এটি মুখস্ত করেছি।
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
বাদল গেছে টুটি,
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি।
ছুটি বিষয়টি আমাদের সকলের মনকেই আন্দোলিত করে। প্রত্যেক শ্রেণি পেশার মানুষ এটিকে নিজের মতো করে উপভোগ করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু এই ছুটিটা যখন শিশুদের বেলায় কিংবা শিক্ষার্থীদের বেলায় হয় তখন তা হয় একটু ব্যতিক্রম। তাদের কাছে ছুটি মানে অনেকটা সকল কিছু থেকেই ছুটি এর মতো।কোন নিয়মের তোয়াক্কা করতে তারা রাজি থাকে না।ঠিকমতো পড়তে বসবে না।দেরি করে বাসায় ফিরবে। বিলে ঝিলে বন্ধুদের সাথে দলবল নিয়ে হইহাল্লা করবে। নানু বাড়ী, দাদু বাড়ী বেড়াতে যাবে। এভাবেই তারা ছুটিটাকে উপভোগ করে।যদিও এখনকার শিশুরা এগুলোর অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের আনন্দের জায়গা গুলোকে সংকীর্ণ করে দিচ্ছে।
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন তা-ই করতাম।আমার স্পষ্ট মনে আছে, যখন ছোট ছিলাম, বিদ্যালয় বন্ধ হলেই আম্মু আমাদের নানু বাড়ী বেড়াতে নিয়ে যেতেন। নানু বাড়ী একটু দূরেই।যেতেও বেশ সময় লাগতো। লম্বা ছুটির কারনে আম্মু সবসমময় আমাদের হাঁস-মুরগী গুলো নিয়ে যেতেন। আব্বু আমাদেরকে দিয়ে আবার চলে আসতেন। জামাই বলে শ্বশুরবাড়ীতে এতো দিন থাকতে চাইতেন না।
কিন্তু আব্বু ছিল খুবই সিরিয়াস। বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনলেই বলতেন- বেশি দিন থাকার দরকার নেই। পড়াশুনার অনেক ক্ষতি হবে।
আরো কড়া অর্ডার ছিল, তোমরা বেড়াতে যাবেই যখন বই খাতা সাথে নিয়ে যাও। যেখানেই থাকো তোমাকে পড়তে হবে। আব্বুর ভয়ে বইখাতা নিয়ে যেতাম ঠিকই কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই এগুলো যেভাবে নিয়ে যেতাম সেভাবেই থাকতো। পড়ার সময় আর হতো না।
পরিনামে কি হতো? ছুটির পর বিদ্যালয় খুললে যখন পরীক্ষা হতো পরীক্ষায় খারাপ করতাম।আব্বু রাগ করে আম্মুকে বলতেন, আরো বেশি বেশি বেড়াও। বেড়ালেই পড়া মুখাস্থ হয়ে যাবে!
এখন মনে হচ্ছে আসলে ঠিক করিনি। পিতামাতা সন্তানের ভালোর জন্যই বলেন। কিন্তু ঐ বয়সে আমরা বুঝতে পারিনি।
দীর্ঘ ছুটির পর বিদ্যালয় খুলছে। এ বছর রমজানের ছুটি এবং গ্রীষ্মের ছুটি একসাথে হওয়ায় ছুটিটা একটু লম্বাই ছিল। একমাস দশদিন প্রায় দেড়মাস। আবার বিদ্যালয় খোলার পর তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে আরো ১০/১৫ দিন সময় লেগে যায়। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এই চিত্র বেশি দেখা যায়। এটা কাম্য নয়। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের উচিত হোম ভিজিট বাড়িয়ে দেয়া।কিংবা অভিভাকদের ফোন করে তাদের শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য তাড়া দেয়া।এখন প্রায় সকল শিক্ষার্থীর অভিভাবকের মুঠোফোনের নাম্বার বিদ্যালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে। এ কাজটা আমরা চাইরেই করতে পারি।
স্বভাবতই শিশুরাই ছুটিকে বেশি উপভোগ করে।বিদ্যালয় বন্ধ হলে তাদের পাঠ চুকে যায়। অনেক অভিভাবক অতি লোভে সন্তানদের কাজে পাঠিয়ে দেয়। গ্রাম অঞ্চলে এই প্রবণতা বেশি। শিশুরা পড়ালেখা থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে অভিভাবকের উদাশীনতা অনেকাংশে দায়ী।
বিদ্যালয় খুললেই শিক্ষার্থীদের উচিত বিদ্যালয়ে নিয়মিত যাওয়া। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২য় সাময়িক পরীক্ষার আর খুব বেশি দিন বাকী নেই। আগামী ১ আগষ্ট থেকেই শুরু হচ্ছে পরীক্ষা। দীর্ঘ ছুটির আমেজ কাটিয়ে উঠে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।
কারন ১ম সাময়িক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। ২য় সাময়িক পরীক্ষার সিলেবাস এখনও শুরুই করা হয়নি।তাহলে এই স্বল্প সময়ে শিশুদের ২য় সাময়িকের জন্য উপযোগী করতে একটু বেশিই শ্রম দিতে হবে।
বছর দুয়েক আগে দুর্গম চর অঞ্চলের কয়েকটি বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে যাই। যদিও পরিদর্শন আমাদের নিয়মিত কাজ। কিন্তু এটা ছিল বিদ্যালয় লম্বা ছুটির পর খোলার সময়কার। বেশির ভাগ স্কুলেই দেখলাম শিশুদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। পরের দিন আবার গিয়েও একই চিত্র দেখে অবাক হলাম। বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষককে নিয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীর বাড়ীতে হোম ভিজিম করতে গেলে অনেককেই বাড়ীতে পাওয়া যায়নি। পূর্বেই বলেছিলাম, লম্বা ছুটি পেলে বহু অভিভাবক একটু বাড়তি আয়ের আশায় শিশুদের কাজে পাঠিয়ে দেয়।
এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। চরে তখন ধান, সয়াবিন এবং বাদামের মৌসুম চলছিল।অভিভাবকদের অনেকেই তাদের সন্তানদের নিজ ক্ষেতে কিংবা অন্যের ক্ষেতে ফসল তোলার জন্য পাঠিয়ে দেয়। এর পর পরই আমি চর অঞ্চলের অনেকগুলো বিদ্যালয়ে উঠান বৈঠক এবং মাঠ সমাবেশ করে অভিভাবকদের এ ব্যাপারে সচেতন করার চেস্টা করেছি।অনেকক্ষেত্রেই সফল হয়েছি। আশানুরুপ ফল পাওয়া গিয়েছে এসবে। ঝরে পড়া অনেকাংশেই কমেছে। নিয়মিত উপস্থিতিও বাড়তে শুরু করেছে।
তাই অভিভাবদের প্রতি অনুরোধ বিদ্যালয় খোলার দিন থেকেই আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠান। সন্তানের ভবিষ্যত গড়ার ক্ষেত্রে একটু সচেতন হোন। দেশের উন্নয়নে অংশীদার হোন।
পরিশেষে শিশুদের উদ্দেশ্যে বলবো:
পড়ো, পড়ো এবং পড়ো
যে পড়ে সে বড়।
লেখক: মুহাম্মদ মুহীউদ্দীন
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার।