২৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:০৮

প্রফেসর শায়েস্তা খান ছিলেন একজন সত্যিকারের নায়ক

প্রয়াত প্রফেসর শায়েস্তা খান এবং লেখক যাহেদুর রহমান  © সংগৃহীত

শিক্ষাবিদ, ক্রীড়া সংগঠক ও ষাটের দশকে চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ ছাত্রনেতা প্রফেসর শায়েস্তা খান গত ২০ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর সার্জিস্কোপ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। 

বহুমাত্রিক গুণে গুণান্বিত এবং হ্যান্ডসাম একজন মানুষের নাম। সুপুরুষ হিসেবে ইংরেজি ‘হ্যান্ডসাম’-এর সঠিক কোনো পরিমাপ নেই এই শব্দের বিস্তৃত ধারণা ‘হ্যান্ডসাম ইজ হোয়াট অ্যা হ্যান্ডসাম ডাজ’, যা একজন মানুষের চলনে, বলনে, কথনে, মননশীলতায়, রুচি ও সৌন্দর্যে এবং কমন বা রেয়ার সেন্সের মানদণ্ডে প্রফেসর শায়েস্তা খান স্যার অনন্য-অসাধারণ উচ্চতার এক মানুষ।

আমি তৎকালীন সরকারি বাণিজ্য কলেজ, চট্টগ্রামে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়ন করি (১৯৮৬ জুলাই থেকে ১৯৮৮ সালের জুন)। সেসময় স্যারকে প্রথম দেখি ১৯৮৭ সালে আন্তঃকলেজ ক্রিকেট খেলার সময় প্যারেড মাঠে। দেখতে বলিউড তারকা দীলিপ কুমার ওরফে ইউসুফ খানের চেয়েও বেশি সুদর্শন ছিলেন। 

তিনি ঐ সময়ে সরকারি হাজী মোহাম্মদ মুহসীন কলেজ দলের পক্ষে ছিলেন। তবে, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ক্রীড়া সংগঠক আলী আব্বাস ভাইয়ের দরাজ কণ্ঠে স্যারের সাথে চাটগাঁইয়া ভাষায় কথোপকথন চলছিল দারুণ মোহনীয় ভঙ্গিতে। আব্বাস ভাই সরকারি কমার্স কলেজের ক্রিকেট দলের সাথে সবসময় সরব থাকতেন।

পরবর্তীতে, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নাসিরাবাদ স্পোর্টিং ক্লাবের জাকির হোসেন লুলু, তৌফিকুল ইসলাম বাবু, প্রফেসর শাহেদুল খবির এবং আমাদের সিনিয়র ক্লাব শহীদ শাহজাহান সংঘের অ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম (পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি), আব্দুল হান্নান আকবর, সিরাজুল হক খান, আব্দুল হাই জাহাঙ্গীর ভাইসহ আরও অনেকের সহযোগিতায় চট্টগ্রামের খুদে খেলোয়াড়দের প্রতিভা বিকাশে সাড়া জাগানো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট মেরিডিয়ান চিপস বিজয় দিবস অনূর্ধ্ব ১৬/১৫ বয়সভিত্তিক খেলায় স্যার প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন বেশ কয়েকবার। মেট্রোপলিটন ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তৎদামপাড়া পুলিশ লাইনস মাঠে মেট্রোপলিটন ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত জুনিয়র ক্রিকেট লীগ মোট নয়বার চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল নাসিরাবাদ স্পোর্টিং ক্লাব।

নাসিরাবাদ স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাকির হোসেন লুলু এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তৌফিকুল ইসলাম বাবু। পরবর্তীতে দীর্ঘসময় শাহেদুল খবির চৌধুরী এরপর আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। উল্লেখ্য, বিজয় দিবস ক্রিকেট টুর্নামেন্ট সম্পাদক হিসেবেও ছিলাম কয়েকবছর। 

শহীদ শাহজাহান সংঘ ও নাসিরাবাদ স্পোর্টিং ক্লাবের যারা কর্ণধার তাদের কাছে শিক্ষা পেয়েছি সততা, ত্যাগ ও নিষ্ঠা। বিশেষ করে, বিচারপতি একেএম আব্দুল হাকিম ছিলেন অসাধারণ ন্যায় নীতিবান ও নিরেট স্পষ্টবাদী একজন নেতা। তার অনুজপ্রতিমদের দীক্ষা দিয়েছেন সফল ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে স্বীকৃতি লাভের। 

কোনো এক সময় শাহেদুল খবির ভাইয়ের বদান্যতায় নাসিরাবাদ স্পোর্টিং ক্লাবের বেশ কয়েকজন মনিরুল ইসলাম মানিক, আব্দুল্লাহ আল হারুন দীপন, সিরাজুল ইসলাম, আমি, ইব্রাহীম, সিনিয়র ও জুনিয়র, এরফানুল ইসলাম খান লাবুসহ আরও অনেকে মেট্রোপলিটন ক্রীড়া সংস্থার বিভিন্ন উপকমিটির সদস্য হিসেবে স্যারের আনুকূল্য পাই। 

এছাড়া, ২০০৫ সালে ইস্পাহানী পাবলিক কলেজ থেকে ইস্তফা দিয়ে চিটাগাং মেট্রোপলিটন কমার্স কলেজ এর উপাধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের পর থেকে সংগত কারণে স্যারের নেতৃত্বে এটি ব্যবসায় শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষ দশ কলেজ হিসেবে উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করে। 

২০১৪-১৫ সেশন থেকে কয়েক বছর ক্রিকেট কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পাই। স্যারসহ মেট্রোপলিটন ক্রীড়া সংস্থার বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন ও অনুপ্রেরণা জোগাতেন। ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি ফুটবল ও হ্যান্ডবল কমিটির সদস্য হিসেবেও। শাহনেওয়াজ রিটন ভাইয়ের পেশাগত ব্যস্ততা একসময় সঞ্চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। বিগত এক দশকের অধিক সময়ে সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা ও স্টেডিয়াম অফিস উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বিশেষ অবদান রেখেছেন ক্রিকেট কমিটির সুযোগ্য সম্পাদক ফরিদ আহমেদ বাবু ভাই। 

স্যারের অগণিত শিক্ষার্থীরা মহানগরী ক্রীড়া সংস্থার কার্যক্রম বেগবান করার জন্য শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক সহযোগিতা করেছেন, পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, যদিও স্যার কদাচিৎ নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়েছেন স্পন্সর পাওয়ার জন্য। পারতপক্ষে, তিনি কখনোই অন্যায়, অনাচার বা অধিকার চর্চা করেছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই। তিনি ছিলেন সত্যিকারের নায়ক। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অবিচল আত্মবিশ্বাস ও অনড় অবস্থানে ছিলেন। 

স্যারের প্রদর্শিত নিয়মে হিসাব বহি সংরক্ষণ ও আপডেট করা, বিভিন্ন টুর্নামেন্ট দল নির্বাচনে হিসাব-নিকেশ অনেক কিছু সম্পর্কেই প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করি। সংস্থার যে কোনো বাইলজ তৈরি, বিভিন্ন প্রকাশনা, শব্দচয়ন ও বাক্য গঠনে স্যারের পাণ্ডিত্যের চিহ্ন রয়েছে।

সংস্থার ব্যাংক হিসাব ও ক্যাশ বুক আপডেট করার নিমিত্তে স্যারের তাগাদা ছিল সবসময়। যতটুকু দেখেছি, সংস্থার তহবিল গঠন ও সংরক্ষণ স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করেছেন, যার ফল হিসেবে স্যারের মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম মহানগরী ক্রীড়া সংস্থার সর্বশেষ সাধারণ সভায় স্যারের পরিবারের পক্ষ থেকে তার ছোট ভাই এনসিসি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত ডিএমডি মোহাব্বত খান, পুত্র ডা. ইশতিয়াক আজিজ খান ও কন্যা ফারজানা কর্তৃক এফডিআরের দলিল হস্তান্তর এবং নগদান বহি মোতাবেক ব্যাংক হিসাব সর্বশেষ গচ্ছিত টাকা বুঝিয়ে দেন। উক্ত সভায় আমাকে সংস্থার নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত করায় ধন্যবাদ ও বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

স্যারের যোগ্য উত্তরসূরি বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, তৈয়বুর রহমানসহ ক্রীড়া সংস্থার সকল সদস্যদের প্রতি। ২০১১ সালে আইআইইউসিতে যোগদান বিস্মিত হয়েছিলেন আমার আরেকজন কল্যাণকামী মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ভাই। এছাড়া, প্রতিটি টুর্নামেন্ট শেষে আমাকে দিয়ে ভাউচারসহ পুরো আয় ব্যয়ের হিসাব চেক করার পর তিনি চূড়ান্ত স্বাক্ষর প্রদান করতেন ‌।

পেশাগত জীবনে তিনি সরকারি বাণিজ্য কলেজ, চট্টগ্রামে প্রভাষক হিসেবে যাত্রা শুরু করে প্রফেসর পদে উন্নীত হন এবং প্রশাসনিকভাবে বিভাগীয় প্রধান, উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ হিসেবে সফলতার সাথে সরকারি কমার্স কলেজ চট্টগ্রামে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে সরকারি মহিলা কলেজ দায়িত্ব পালন শেষে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বাণিজ্যিক ও শিল্প আইন বিষয়ক পুস্তক রচনা ও সম্পাদনা করেছেন, যা পাঠ্যবই হিসেবে পুরো বাংলাদেশে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। 

পারিবারিক জীবনে সুখী ও সমৃদ্ধ শায়েস্তা খান দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। নাতি নাতনিদের সাথে তাদের খুনসুটি ও সখ্য ছিল বরাবরই প্রাণবন্ত। স্যারের স্ত্রীর প্রয়াণে যেমন : অঝোরে কাঁদতে দেখেছি, তেমনি কয়েক মাসের ব্যবধানে শায়েস্তা খান স্যারের অন্তিম যাত্রা যেন ডাহুক-ডাহুকীর অনল প্রেম বিরহই। 

তিনি ছাত্রজীবনে সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন, কিন্তু পেশাগত জীবনে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেখিনি, যদিও ওয়ান ইলেভেনের সময় তাকে উপদেষ্টা বা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাবার জোর গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল। তিনি চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী নিয়মিত কলাম লেখক হিসেবে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও বিশেষ সাময়িকীতে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

তবে, ক্রীড়া সংস্থার সব কার্যক্রম দলমত নির্বিশেষে স্বাধীন ও সার্বজনীন করার পক্ষে ছিলেন, ফলে চট্টগ্রাম মহানগরী ক্রীড়া সংস্থা সব ধরনের হিংসা বিদ্বেষ বা সমীকরণের ঊর্ধ্বে ছিলো। 

স্বল্প পরিসরে স্যারের সম্পর্কে লেখা যেমননা, তেমনি আমার মতো ক্ষুদ্র মানউল্লেখ্য, প্রফেসর শায়েস্তা খানের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১০ জুন চট্টগ্রাম নগরের আলকরণ কমার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেন। ষাটের দশকে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ ছাত্রনেতা ছিলেন শায়েস্তা খান। গণঅভ্যুত্থানসহ তৎকালীন রাজনীতিতে তিনি অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

খেলা অন্তপ্রাণ মানুষ ছিলেন প্রফেসর শায়েস্তা খান। ১৯৬১-৬২ সালে তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে একই কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে সরকারি কমার্স কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন । ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড কেন্দ্রীয় ক্রীড়া সাংগঠনিক কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৯০ সাল থেকে চট্টগ্রাম মহানগরী ক্রীড়া সংস্থার আমৃত্যু সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।


লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, গুলশান -২, ঢাকা।
ই-মেইল: zahed.zahed@yahoo.com