রমজানের শেষ দশকে শবে কদর তালাশ
লাইলাতুল কদরের বিধান অবতীর্ণ হয়েছে মদিনা শরিফে। কেননা সুরা কদর মদিনা শরিফেই অবতীর্ণ হয়েছে। এটি মুসলমানদের জন্য অতিমূল্যবান রাত। কিছু রাত-দিন আছে, যা নবীর জন্য মূল্যবান। আবার কিছু রাত-দিন আছে, যা আমাদের জন্য মূল্যবান। এরমধ্যে বিশেষ কিছু ফজিলতপূর্ণ রাত আছে, তার মধ্যে সেরা রাত হলো লাইলাতুল কদর বা কদরের রজনী।
কদরের রজনীর পরিচিতি মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে নিজেই তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এটা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে। আর মহিমান্বিত রজনী সম্পর্কে তুমি কী জানো? মহিমান্বিত রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। ওই রাত্রিতে ফেরেশতারা ও রুহ (জিবরাইল) অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজের জন্য তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এই রাত ফজরের উদয় পর্যন্ত।’ (সুরা: কদর, আয়াত: ১-৫)
সাধারণত কদর রজনী শেষ দশকে হওয়াই বিশুদ্ধ অভিমত। হজরত আবু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবু সায়িদকে জিজ্ঞেস করেছি, সে আমার বন্ধু ছিল। তিনি বলেন, আমরা নবী করিম (সা.) এর সঙ্গে রমজানের মধ্য ১০ দিন ইতিকাফে ছিলাম। তিনি ২০ তারিখ সকালে বের হন এবং আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভাষণে বলেন, আমাকে কদরের রজনী দেখানো হয়েছিল, অতঃপর ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তোমরা তা শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে তালাশ করো। আমি নিজেকে মাটি ও পানিতে সিজদা করতে দেখেছি। তাই যারা রাসুলের সঙ্গে ইতিকাফে ছিল, তারা যেন ফিরে আসে। তখন আমরা ফিরে এসেছি। আমরা আকাশে কোনো মেঘ দেখিনি। হঠাৎ একরাতে মেঘ এলো, বৃষ্টি হলো, মসজিদের ছাদ ভেসে গেল। তা ছিল খেজুরগাছের ঢালের এবং নামাজ শুরু হলো, তখন আমি রাসুল (সা.) কে দেখেছি, তিনি পানি ও মাটিতে সিজদা করছেন। এমনকি তাঁর কপালে মাটির চিহ্ন ছিল।’ (বুখারি, হাদিস: ২০১৬)
আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, শেষ দশকের বিজোড় রাতের মধ্যে শেষের দিকের কয়েকটি রাতে শবেকদর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
সহিহ বুখারির অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘হজরত উবাদা ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) আমাদের কদরের রজনীর খবর দেওয়ার জন্য বের হয়েছেন। তখন দুজন মুসলিম পরস্পর ঝগড়া করে। তিনি বলেন, আমি বের হলাম তোমাদের কদরের রজনীর খবর দেওয়ার জন্য। কিন্তু অমুক অমুক ঝগড়া করে, অতঃপর তা তুলে নেওয়া হয়েছে। তাতে তোমাদের জন্য কল্যাণ থাকতে পারে। তাই তোমরা শেষের পঞ্চম, সপ্তম ও নবম তারিখে তালাশ করো।’ (বুখারি, হাদিস: ২০২৩)
অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, সাহাবাদের একদলকে শেষের সাত দিনে কদরের রজনী স্বপ্নে দেখানো হয়েছে। তখন রাসুল (সা.) বললেন, আমি তো দেখছি তোমাদের দেখা স্বপ্ন শেষের সাত দিনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তাই যে ব্যক্তি তা তালাশ করবে, সে যেন শেষের সাত দিনেই তা তালাশ করে।’ (বুখারি, হাদিস: ২০১৫)
প্রশ্ন হলো, প্রতিবছর লাইলাতুল কদর কি একই তারিখে হয়? এর জবাব হলো— ইমাম মালেক, আহমদ, সুফিয়ান সাওরি, ইসহাক ও আবু সাওর (রহ.) বলেন, লাইলাতুল কদর শেষ দশকে পরিবর্তন হতে থাকে।
তবে ইমাম আবু হানিফা, সাহেবাইন, ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর মতে, তা নির্দিষ্ট তারিখে হয়, পরিবর্তন হয় না। সাধারণত ইমাম শাফেয়ি লাইলাতুল কদর ২১ তারিখে হওয়ার কথা বলেছেন। আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, তা ২৭ তারিখে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তবে ২৭ তারিখে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিভিন্ন দেশে ২৭ তারিখকে লাইলাতুল কদর হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর বিভিন্ন কারণ আছে।
ইমাম মুসলিম (রহ.) বর্ণনা করেন, হজরত জির (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি উবাই ইবনে কাব (রা.) কে বলতে শুনেছি, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি পুরো বছর রাত্রি জাগরণ করবে, সে কদরের রজনী পেয়ে যাবে। তখন উবাই (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! যিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তা রমজানে। তিনি কসম খেয়ে বলতেন, আল্লাহর কসম! আমি জানি, তা কোন রাত। তা ওই রাত, যার ব্যাপারে রাসুল (সা.) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন রাত্রি জাগরণের জন্য। আর তা হলো ২৭ তারিখের রাত। এর নিদর্শন হলো, সেদিন সূর্য উদয় হবে কিরণবিহীন। (মুসলিম, হাদিস: ৭৬২)
তবে মুসলিম গবেষকরা বলছেন, সুরা কদরে শব্দ রয়েছে ৩০টি। সেখানে রয়েছে ‘হিয়া’ শব্দ, যা দ্বারা লাইলাতুল কদর বোঝানো হয়েছে। ওই শব্দটি রয়েছে ২৭ নম্বরে।
তাফসিরে কবিরে এসেছে, ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘প্রিয় গণনা আল্লাহর কাছে বিজোড়। আর বিজোড়ের মধ্যে প্রিয় হলো সাত। তাই তিনি আসমান সাতটি বানিয়েছেন, জমিন সাতটি বানিয়েছেন, আর সপ্তাহে সাত দিন দিয়েছেন। জাহান্নামের স্তর সাতটি। তাওয়াফের চক্কর সাতটি, সিজদায় সাত অংশ ব্যবহার করা হয়, তাই লাইলাতুল কদর ২৭ তারিখ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’ (তাফসিরে কবির, খণ্ড ৩২, পৃষ্ঠা: ২৩০)
এছাড়া কারণ হতে পারে, সুরা কদরে লাইলাতুল কদর শব্দ তিনবার ব্যবহৃত হয়েছে। আর তাতে অক্ষর রয়েছে ৯টি করে। তাই মোট অক্ষর ২৭ হয়।
ইবনে আবি শায়বা বর্ণনা করেন, হজরত কানান ইবনে আবদুল্লাহ নাহমি থেকে বর্ণিত, আমি জির (রা.) কে কদর রজনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি? তিনি বলেন, ওমর, হুজাইফা ও অনেক সাহাবির মতে ২৭ তারিখ। তাঁরা তাতে সন্দেহ করতেন না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস: ৮৭৫৮)
ইমাম তিরমিজি (রহ.) বর্ণনা করেন, হজরত আবু জর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসুল (সা.) এর সঙ্গে রোজা রেখেছি। তিনি আমাদের সঙ্গে নামাজ পড়েননি। যখন সাত দিন অবশিষ্ট রইল, তখন তিনি আমাদের সঙ্গে তারাবির নামাজ দ্বারা রাত্রি জাগরণ করেন। রাতের এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত। অতঃপর তিনি আর আমাদের সঙ্গে ষষ্ঠ দিন বাকি থাকা অবস্থায় রাত্রি জাগরণ করলেন না এবং আমাদের সঙ্গে পঞ্চম দিন তথা ২৩ রমজান রাত্রি জাগরণ করলেন ও তারাবি জামাতে আদায়ের মাধ্যমে রাতের অর্ধেক অতিবাহিত করেছিলেন। আমরা তাঁকে বললাম, যদি বাকি রাতও নফল হিসেবে আমাদের সঙ্গে কাটাতেন? তখন তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে রাত্রি জাগরণ করে, শেষ পর্যন্ত তাকে সারা রাত জাগরণের পুণ্য দেওয়া হবে। অতঃপর তিনি আমাদের সঙ্গে রাত্রি জাগরণ করেননি, মাত্র তিন দিন অবশিষ্ট রইল এবং আমাদের সঙ্গে তৃতীয় দিন (২৭ তারিখে) জামাতে নামাজ পড়লেন এবং তার পরিবারকেও জাগ্রত করলেন। এমনকি আমরা সাহরি খাওয়ার সময় চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলাম। আমরা বলার পর তিনি সাহরি সমাপ্ত করেন।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৮০৬)
তবে যে তারিখেই হোক শবে কদর, সারকথা হলো লাইলাতুল কদর শেষ দশকেই বিদ্যমান। আর তা ২৭ তারিখে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আল্লাহ তা আমাদের থেকে গোপন রেখেছেন, যাতে মানুষ তা তালাশের জন্য চেষ্টা করে চেষ্টারও সওয়াব পায়। আর মানুষ যেন শুধু একটি রাতের ইবাদত না করে। কদরের রজনী বছরের সেরা রজনী। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, ওই রাতের মূল্যায়ন করা।