কুঁড়ি বায়োটেকনোলজিস্টদের বিদায় বেলা
আজ থেকে প্রায় চার বছর আগে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাঙ্গণ প্রাণ ফিরে পেয়েছিল ১৬তম ব্যাচের পদচারণায়। তখন কে জানত-এই একই আঙিনা একদিন সাক্ষী হবে বিদায়ের দীর্ঘশ্বাসের, জল ছল ছল নীরব চোখের ভাষার?
সময়ের স্রোতে তাদের দিনগুলো বয়ে গেছে ভালো–মন্দ অভিজ্ঞতা, পাওয়া–না পাওয়ার গল্প, মান–অভিমান আর উপেক্ষা–অপেক্ষার ভেতর দিয়ে। একই পরিচয়ে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কখনো তৈরি হয়েছে দূরত্ব, কখনো আবার সেই দূরত্ব ভাঙার আন্তরিক চেষ্টা। আর আজ, সময়ের সেই দূরত্ব যেন শেষ প্রান্তে এসে থেমে দাঁড়িয়েছে, একটি অনিবার্য বিদায়ের সামনে।
প্রস্থান যখন দরজায় কড়া নাড়ে, তখন মান–অভিমান আর কতটুকুই বা জায়গা পায়? যখন চলে যেতেই হয়, তখন একরাশ মুগ্ধতার পদচিহ্ন রেখে যাওয়াটাই যেন শ্রেয়। রাত–প্রভাত–দুপুরে যে নামগুলো নির্ভার কণ্ঠে ডাকা হতো, চা-স্টলের আড্ডায় যে নামগুলো আপন হয়ে থাকত, সেগুলোও একদিন ধীরে ধীরে দিনলিপির পাতা থেকে ঝরে পড়বে, এই ভাবনাতেই মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
তবুও জগতের এই অটল নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় যে নেই, এভাবেই তো মানুষের চলাচল।
সময় বদলায়, সম্বোধনও বদলায়। আজ যেভাবে অবলীলায়, গাঁয়ে হেলে একে অপরের সঙ্গে কথা বলা যায়, কাল চাকরির খাতায় নাম লেখানোর সময় তা হয়তো কেবলই এক আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকবে। তবু উচ্চস্বরে বলতে ইচ্ছে করে-'তোরা ছিলি, তোরা আছিস, তোরাই থাকবি'। একজন মানুষের পুরো ব্যক্তিত্বে তার পরিবেশের বড় একটা প্রভাব থাকে। আজ যারা বায়োটেকনোলজিস্ট হয়ে দেশ ও মানবতার জন্য কিছু করবে, তার কৃতিত্ব শুধু তার একার নয়। তার মনন, তার চিন্তার বিস্তারে—অচেতনেই হলেও—পুরো ব্যাচের খণ্ড খণ্ড অবদান জড়িয়ে আছে।
একেক জায়গা থেকে আলোর ফুলকিরা এসে যেমন একসময় একত্র হয়েছিল, আজ সময় এসেছে আবার আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ার। বলতে ইচ্ছে করে, মন তো চায় আর একটু থাকি—কিন্তু নিয়তির আর গতিধারার নিয়ম মেনেই তো এগোতে হয়।
এই কাতর বিদায়গুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়- পৃথিবীতে কোনো সম্পর্কই চূড়ান্ত নয়। একমাত্র মানুষের রবের সঙ্গে সম্পর্কই পরম; বাকিগুলো সময়ের স্রোতে রূপ বদলায়। শৈশবের দিনলিপিতে যে নামগুলো বারবার ফিরে আসত, আজকের দিনলিপিতে সেগুলো আর ততটা জায়গা পায় না। সামনে এগিয়ে চলা জীবনের পাতায় হয়তো নতুন নতুন গল্প জায়গা করে নেবে। বিদায় যে জগতের এক চলমান নীতি। তাই যদি হাসি দিয়ে সারাজীবনের বেদনা লুকানো যায়, আজ বিদায়ের দিনেও বিদায় শোক লুকিয়ে শুধু হাসিটাই দেখা যাক।
স্মৃতিপটে এই বিদায়ের পদচিহ্ন এঁকে রাখতে বিজিই–১৬ ব্যাচ আয়োজন করে এক প্রীতি ট্যুরের। বান্দরবান ও কক্সবাজারের নানান প্রান্ত ছুঁয়ে তারা পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফি রিসার্চ ইনস্টিটিউট। বিদায়ের এই সময়ে সেই ভ্রমণ হয়ে ওঠে বন্ধন, স্মৃতি আর ভালোবাসার এক শেষ; তবু দীর্ঘ স্মৃতির অধ্যায়। আজ প্রাণ খুলে বলতে ইচ্ছে করে—পথে চলতে গিয়ে হওয়া অযাচিত ভুলগুলো সবাই ভুলে যাস। অভিমান ঝেড়ে ফেলে একসঙ্গে চলো, দেশ ও দশের কল্যাণে নতুন অভিযানে। মাটি ও মানুষের সুনিবিড় অন্তর জয় করাই হোক আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ।
কুড়ি হয়ে আমরা বের হয়েছিলাম একদিন—একদিন আমরা ফুল হয়ে ফুটব। এই হোক বিদায়ের ঐকতান। বিদায়ের একটাই আকুতি কেউ ভুলে যাসনে।
এই একত্রিত স্মরণীয় আয়োজনের পেছনে ছিল Bioted গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং GenX এডভান্সড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
লেখক: বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়