ধর্ষণ মামলায় বিচারে প্রতিবন্ধকতা কেন?
বিগত কয়েক বছর যাবত ধর্ষণ হত্যা এসব এখন দেশে প্রতিদিনের সংবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণ হত্যার পরিসংখ্যান দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবে। গত কয়েক বছরে সারাদেশে ধর্ষণ সংখ্যা অকল্পনীয়। বাস্তব বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই বাজে প্রকৃতির অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইন রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তেমন সফল হতে পারছে না। কারণ ধর্ষণের সাথে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার জড়িত।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও তার শাস্তি
১.যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল (১৬) বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া, অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন৷
২. যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী অন্য কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
৩. যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
৪. যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া যদি কেউ ধর্ষণের চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
আধুনিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে দিন দিন ধর্ষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, অফিস, রাস্তা-ঘাট, বাস কোথাও আছ নারীরা আজ নিরাপদ নয়। সুযোগ পেলেই বিকারগ্রস্ত পুরুষদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে নারী। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কিশোর বয়সের মেয়েরা। এরপরেই রয়েছে অল্পবয়সী মেয়ে শিশুরা যাদের প্রতিরোধের শক্তি-সাহস কোনটাই নেই।
বিগত পাঁচ বছরের ধর্ষণের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে মোট ধর্ষণ ৭০৭টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৩৮৭টি, গণধর্ষণ ২০৮, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৬৮, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ১৩ আর ধর্ষণ চেষ্টা ৮১টি। ২০১৫ সালে মোট ধর্ষণ ৮৪৬টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৪৮৪টি, গণধর্ষণ ২৪৫, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৬০, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ২ আর ধর্ষণ চেষ্টা ৯৪টি।
২০১৬ সালে মোট ধর্ষণ ৭২৪টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৪৪৪টি, গণধর্ষণ ১৯৭, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৩৭, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ৮ আর ধর্ষণ চেষ্টা ৬৫টি। ২০১৭ সালে মোট ধর্ষণ ৮১৮টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৫৯০টি, গণধর্ষণ ২০৬, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৪৭, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ১১ আর ধর্ষণ চেষ্টা ১০৪টি।
২০১৮ সালে মোট ধর্ষণ ৭৩২টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ৫০২টি, গণধর্ষণ ২০৩, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ৬৩, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ৭ আর ধর্ষণ চেষ্টা ১০৩টি। আর ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, মোট ধর্ষণ ৩৫৪টি। এর মধ্যে একক ধর্ষণের সংখ্যা ২৫৬টি, গণধর্ষণ ৯৪, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা ১৮, ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা ৬ আর ধর্ষণ চেষ্টা ৫৫টি। (সূত্র দৈনিক ইত্তেফাক)
আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা যত ঘটে, তার বেশির ভাগই আইনের আওতায় কিংবা জন সম্মুখে আসে না। কারন সমাজে ধর্ষিতা ভিন্নভাবে দেখা হয় এছাড়াও থানায় যাওয়া, মেডিকেল পরীক্ষা, আদালতে এসে সাক্ষী দেয়া এগুলোও নারীর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার মানসিক শক্তি সবার থাকে না
বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষ বলছে, তারা এক গবেষণার অংশ হিসাবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি জেলায় ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছে। এ গবেষণাটির পরিচালক এবং নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক রওশন আরা বলেন এ সময়ে ৪ হাজার ৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে, কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচ জনের।
আইনে ধর্ষণের শাস্তি দেওয়া থাকলেও ধর্ষণের শাস্তি কেন হচ্ছে না?
সাধারণত ধর্ষণ মামলায় ভিকটিমকেই তার ‘ইনোসেন্স’ প্রমাণ করতে হয়। এইখানেই হয়রানির স্বীকার হন নারীরা এর কারণে নারী নিজে বা তার পরিবার যেতে চান না মামলায় মোকদ্দমায়। মামলা উঠিয়ে নেওয়ার মতো বিষয়গুলো পরিসংখ্যানগত দিক থেকে অনেক বেশি ঘটে। আমাদের মূল সমস্যা সাক্ষ্য আইন।
সাক্ষ্য আইনে ১৫৫ ধারার ৪ উপ-ধারার সুযোগে ধর্ষক সাধারণত ধর্ষিতাকে ‘কুচরিত্রা’ প্রমাণের চেষ্টা করে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে ওইরূপ প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষক ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারেন। এ ধারায় বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।
আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সংখ্যা কম। বিচারে দীর্ঘসূত্রিতায় ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। ঘটনার পর ডাক্তারি পরীক্ষায় দেরি হওয়ায় মূল অপরাধ প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সাধারণত বিচারের সময় ধর্ষণের শিকার যিনি তাকেই প্রমাণ করতে হয় তার ওপর সংঘটিত অপরাধ।
ডাক্তারি পরীক্ষায় ভুক্তভোগীর পুরো শরীরে, যৌনাঙ্গের ভেতরে ও বাইরে জোরপূর্বক সঙ্গমের আলামত খোঁজা হয়। নারী ফরেনসিক ডাক্তারের অভাবে পরীক্ষাগুলো অনেক সময় পুরুষ ডাক্তার দ্বারা করা হয় বলে অনেক মেয়ে পরীক্ষা করাতেই চান না। তথাকথিত ‘দুই-আঙুলি’ পরীক্ষায় যোনিপথের প্রবেশযোগ্যতা ও পর্দার (হাইমেন) অবস্থাও দেখা হয়। যদিও কিছুদিন আগে হাইকোর্ট একটি রায়ে ধর্ষণের ক্ষেত্রে এ পরীক্ষা নিষিদ্ধ করেছেন।
জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্নভাবে ধর্ষণ মামলার আসামি জামিন পেয়ে যায়। টাকার দাপটে কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতায় ধর্ষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়।
আমাদের দেশে ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করে। আসলে এসব প্রতিবাদ লোক দেখানো ছাড়া আর কিছুই নয়। কারন আদালতে বিচারকার্য আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয় আন্দোলন অনুযায়ী না। আর ধর্ষকরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়েই বেরিয়ে আসে। আমাদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে আইন এবং বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য।এই পর্যন্ত ধর্ষণের বিচারের দাবিতে আন্দোলনতো কম হয়নি কিন্তু বিচার কতজনের হয়েছে বলতে পারবেন? ধর্ষণের বিচার চেয়ে প্রতিবাদ করে কোন লাভ নেই যদি না কার্যকরী আইন থাকে।
সামাজিকভাবে ধর্ষণের অপরাধ অতি ঘৃণ্য হিসেবে বিবেচ্য। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অনেক ইতিবাচক বিবৃতি পাওয়া যায়। কিন্তু ধর্ষণের আসামি ঠিকই আইনের চোখকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা আশা করি, সরকার এ বিষয়ে আরো অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। দেশে প্রচলিত আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিবে।
লেখক: হাবিবুল্লাহ আল মারুফ
শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়