১৭ রমযান: ঐতিহাসিক বদর দিবস
বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলির একটি। নবুওয়াতপ্রাপ্তি থেকে পরবর্তী তের বছর রাসূলুল্লাহ (সা.) যা কিছু অর্জন করেছিলেন তাঁর আনুষ্ঠানিক উপস্থাপন ছিল বদর যুদ্ধ। একদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) যে সত্ত্বার অস্তিত্ব ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা যেমন এ দিনে মঞ্চায়ন হয়েছিল। অন্যদিকে তাঁর সাহাবাগণ (রা.) ঈমানের যে সাক্ষ্য দিতেন ও তাঁর জন্য সর্বস্ব ত্যাগের যে ঘোষণা দিতেন তারও ষোলকলাপূর্ণ করে দেখিয়েছিলেন বদরের যুদ্ধে।
মোটকথা আল্লাহ ও তাঁর বন্দা উভয়েই তাঁদের স্ব-স্ব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করে একটি নতুন সভ্যতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। যা পরবর্তী এক হাজার বছর পর্যন্ত পৃথিবীর পরাশক্তিরূপে দাঁড়িয়েছিল। যে ঘোষণার সাথে কেবল ইসলাম নয়, বরং বিলুপ্ত প্রায় মানবতার ও মানুষের ভাগ্য সবকয়টিই জড়িয়েছিল দিনটির সাথে।
বদরের দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দোয়া থেকে এটি আরো স্পষ্ট হয় যে, ‘হে আল্লাহ! যদি তুমি এই ক্ষুদ্র জনপদকে ধ্বংস করে দাও তাহলে দুনিয়ার বুকে আর তোমার ইবাদত করার কেউ থাকবেনা’। (যা’দুলমা’আদ) আল্লাহ তা’য়ালা এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) বলে সম্বোধন করেছেন। (আল আনফাল/৪১) বিখ্যাত চিন্তাবিদ আবুল হাসান আলী নদভী যথার্থ বলেছেন, ‘এরপর থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানরা যত বিজয় ও সাফল্য অর্জন করেছে, যতগুলো সাম্রাজ্য কায়েম করেছে তার সবই এ প্রকাশ্য ও অবধারিত বিজয়েরই নিকট ঋণী যা বদর প্রান্তের সেই মুষ্টিমেয় দল লাভ করেছিল।’ (নবীয়ে রহমত)
বদর যুদ্ধ:
মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ও হত্যার ষড়যন্ত্র টের পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদেরসহ মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। সহায় সম্পদহীন মদিনার মুসলমানদের প্রতি তাঁদের নির্যাতনের মানসিকতা ও মুসলমানদের ধ্বংসের শপথ থেকে তখনো তারা পিছুপা হয়নি। এমনকি তাদের সামরিক বাহিনী কখনো কখনো মদিনার সীমান্ত ও চারণভূমি পর্যন্ত পৌঁছে যেত। ছোট খাটো সংঘর্ষ ও হত মুসলমানদের সাথে। (সিরাতে ইবনে হিশাম, যা’দুলমা’আদ)।
এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) সংবাদ পেলেন আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে কুরাইশদের বিরাট এক বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে মক্কা যাচ্ছে। এ সম্পদ ছিল তাদের, যারা মুসলমানদের সম্পদহারা সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব করেছে এবং যারা তাদের সমুদয় সম্পদ ও শক্তি মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য ব্যয় করে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক এ কাফেলার সম্পদও যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজে লাগবে তাতেও কোন সন্দেহ ছিলনা। কাজেই রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কাফেলাকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন। সাথে সৈন্য মাত্র ৩১৩ জন (মতান্তরে ৩১৪ বা ৩১৫, ফাতহুলবারী/৭)।
এ কাফেলার ঘোড়া দুটি ও উট মাত্র সত্তরটি। পালাক্রমে একটিতে তিন জন করে সওয়ার হতেন। মক্কায় খবর পৌঁছলে আবু জেহেলের নেতৃত্বে সুসজ্জিত এক হাজার যোদ্ধা মুসলমানদের আক্রমণের জন্য রওনা দেয়। এদের বাহিনীতে ছিল ৭০০ উট, ৩০০ ঘোড়া, যোদ্ধাদের সকলেই লৌহবর্ম পরিহিত। সাথে লোভনীয় খাদ্য, মনোরঞ্জনের জন্য গায়িকাও রেখেছেন তাদের কাফেলায় (সীরাতে মুস্তফা)
যাহোক ১৭ রমযান, শুক্রবার কাফেরদের সাথে চূড়ান্ত যুদ্ধ হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) নির্দেশ দিলেন, ‘এগিয়ে যাও সে জান্নাত বরাবর যার প্রশস্ততা আসমান-জমিন বরাবর।’ শুরু হল যুদ্ধ। হযরত উমায়ের (রা.) খেজুর খাচ্ছিলেন, সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, খেজুর শেষ হতে অনেক বাকি, এতক্ষণ বেঁচে থাকার মত ধৈর্য আমার নেই। তারপর যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, শহীদ হলেন। সকল সাহাবাদের অবস্থাও একই ছিল। খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.) ও প্রত্যক্ষযুদ্ধ করলেন। তিনি ছিলেন সেদিন শত্রুর সবচেয়ে কাছাকাছি। তাঁর চেয়ে বড় বাহাদুর সেদিন কেউ ছিলেন না। (যা’দুলমা’আদ ২/৪২৫)
এভাবে যুদ্ধ শেষ হল। ফলাফলে মুসলমানদের আল্লাহ তা’য়ালা এ যুদ্ধে মহাবিজয় দান করলেন। কাফেরদের প্রায় সকল নেতাসহ ৭০ জন নিহত হয় ও ৭০ জন বন্দি হয় সাথে মুসলমানদের হস্তগত হয় বিপুল যুদ্ধলব্ধ সম্পদ। মুসলমানদের ১৪ জন শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন। এদেরমধ্যে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনসার। যুদ্ধবন্দিদের পরবর্তীতে মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়। (যুদ্ধের বিস্তারিত ঘটনা জানতে দেখুন তারীখে ইবনু কাসীর, সিরাতে ইবন হিশাম, যা’দুলমা’আদ, নবীয়ে রহমত, সীরাতে মুস্তফা)
আল্লাহ ও রাসুলের সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি রক্ষা:
বদরের যুদ্ধের অনেক শিক্ষা রয়েছে, সবগুলোকে একসাথে বলা যায় যে সাহাবারা (রা.) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) সাথে কৃত ওয়াদা রক্ষা করেছিলেন। এটি ছিল ঈমানের ওয়াদা, যা ঈমান আনার সাথে সাথে আবশ্যক হয়ে যায়। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা কেউ মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তোমাদের নিকট প্রিয় হই নিজের পিতা মাতা, সন্তানসন্ততি ও সকল মানুষের থেকে।’ (বুখারী ও মুসলিম)
যুদ্ধের ব্যাপারে যখন সাহাবাদের পরামর্শ চান তখন তাঁরা বলে উঠেন, ‘আপনি যেখানে খুশি চলুন, যার সঙ্গে ইচ্ছা সম্পর্ক স্থাপন করুন, যার সঙ্গে ইচ্ছা সম্পর্ক ছিন্ন করুন, আমাদের ধন সম্পদ যত খুশি গ্রহণ করুন এবং যত খুশি দান করুন। আর তা এজন্য যে আপনি যা কিছু গ্রহণ করবেন তা আপনি যা বর্জন করবেন তার তুলনায় আমাদের নিকট অনেক বেশি প্রিয় হবে। আপনি যা হুকুম করবেন আমরা তান নত মস্তকে মেনে নিব। আল্লাহর কসম আপনি যদি চলা শুরু করেন, এমনকি ‘বারকুলগিমাদ’ পর্যন্তও পৌঁছে যান তবুও আমরা আপনার সঙ্গে চলতে থাকব। আপনি যদি সমুদ্রে প্রবেশ করেন আমরা সমুদ্রেই ঝাঁপিয়ে পড়ব।’ (যা’দুলমা’আদ, ইবনে হিশাম, বুখারী ও মুসলিম)
উমায়ের ইবনে আবি ওয়াক্কাস বালক সাহাবি উনার বয়স মাত্র ষোল। লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছিলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) দেখে ফেরত পাঠাতে চাইলেন এ বালককে। তিনি কাঁদতে শুরু করলেন, শাহাদাতের সুযোগ বুঝি হাত ছাড়া হয়ে গেল। তাঁর কান্না শুনে শেষ পর্যন্ত অনুমতি দেয়া হল, এবং তিনি যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হলেন। (উসদুলগাবা ৪/১৪৮)
যুদ্ধে উযায়ের ইবনে উমায়ের বন্দি হয়ে আসে। ভাই মুসলিমদের পতাকা বাহি হযরত মুস’আব ইবনে উমায়ের তাকে বাঁধতে দেখে বললেন, ‘একে ভাল করে বাঁধ, এর মা অনেক ধনী। মুক্তিপণ বাবদ বেশ ভাল অঙ্ক মিলবে।’ আরো বললেন, ‘তুমি আমার ভাই নও, ভাই তো সেই যে তোমাকে বাঁধছে।’
এ যুদ্ধ ছিল ঈমানের প্রতিশ্রুতি পূরণের, আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পালনের। এ ওয়াদা পালনে ভাই ভাইকে পিতা পুত্রকে হত্যা করেছে। (বিস্তারিত দেখুন- হায়াতুস সাহাবা) যুদ্ধবন্দিদের মধ্যেও খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জামাতা, চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ও চাচাত ভাই আকিল ছিলেন। আর তাঁদের সাথেও কোন বিশেষ ব্যবহার করা হয়নি। (সিরাতে ইবনে হিশাম, তারিখে ইবনু কাসির)
বান্দার সাথে আল্লাহর কৃত প্রতিশ্রুতি পূরণ:
এ যুদ্ধে বান্দা যেমন তাঁর কৃত প্রতিশ্রুতি পালন করেছিলেন, তেমনি আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর প্রতিশ্রুতি এমনভাবে পূর্ণ করেন যে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার সাহায্যের ব্যাপারে ‘বদর’ একটি উপাখ্যান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘বদরের মত সাহায্য’ মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস ও দোয়ায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত শব্দ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কাফেরদের ভেতরে ভিতি সঞ্চার হয়েছে (সূরা আলে ইমরান: ১৫২)। বৃষ্টি বর্ষণ করে মু’মিনের অন্তরকে প্রশান্ত করা ও বালুময় স্থানকে শক্ত করে দেয়া (সূরা আনফাল: ১১)। ঘুম দিয়ে যুদ্ধে পেরেশান মু’মিনের হৃদয়কে দুশ্চিন্তা মুক্ত করা (সূরা আনফাল: ১০)। সবশেষে থেকে ফেরেশতা অবতরণ করে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করানো (সূরা আনফাল: ১২)। এসবই এমন নিয়ামত যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সাথে কৃত প্রতিশ্রুতির শতভাগ পূর্ণ করেছিলেন।
এ যুদ্ধে শয়তান তার বাহিনী নিয়ে কাফেরদের পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল (খাসায়েসুল কুবরা ১/২০৪)। পাঁচ হাজার ফেরেশতা ও তাদের মোকাবেলায় মুসলিমদের পক্ষে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে নেতৃস্থানীয় তিনজন ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (বুখারী), হযরত মিকাঈল (মুসনাদে আহমদ), ও হযরত ইসরাফিল (কাসায়েসুল কুবরা ১/২০১) অংশ গ্রহণ করেন। তাঁরা প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করেন, কোথাও কোথাও মুসলমানদের সাহায্য করেন। (এ বিষয়ে আরও তথ্যর জন্য দেখুন- হায়াতুস সাহাবাহ)
চেতনার একটি ভুল প্রয়োগ:
বদরের যুদ্ধে এক হাজার সশস্ত্র সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র তিন’শ তের জনের বিজয়কে অনেকে একটি মানদন্ড হিসেবে দাঁড় করান যে, মু’মিনদের লোকবল ও সৈন্য কোন বিষয় নয়। বরং আল্লাহর উপর ভরসা করে যুদ্ধের ডাক দেয়া উচিত। ধারণাটি ভ্রান্ত। সিরাতের গভীর অধ্যয়ন করলে দেখা যায় এ যুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করার জন্য বের হননি, বরং বাণিজ্য কাফেলাকে উদ্দেশ্য করে হয়েছিলেন। তাই বদরে অংশ গ্রহণ যারা করেননি সেসব সাহাবিকেও মন্দ বলা হয়নি। যুদ্ধ আল্লাহর ইচ্ছায় ছিল, কাজেই বিজয় ও তাঁর ইচ্ছাতেই হয়েছে। রাসূলুল্লাহর সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবতাকে সামনে রেখে হত। কাজেই লোক বল যাই হোক যুদ্ধের জন্য ঝাঁপিয়ে পরতে হবে এ তত্ত্ব সঠিক নয়। হ্যাঁ অপর পক্ষ যদি আক্রমণ করে তাহলে তার জবাব দেয়া অসহায় অবস্থাতেও কর্তব্য।
আল্লাহ আমাদের বদরের শিক্ষা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি পূরণের তাওফিক দিন। আত্মত্যাগ ও আনুগত্যের সেই আদর্শ আমাদের মধ্যেও ফুটে উঠুক। আমীন।
লেখক: মোজাজ্জাজ আল মাদলাজী
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১০ম ব্যাচ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ