বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন সাধারণ মানুষ ছিলেন না। তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আন্দোলন থেকে একটি সংগ্রাম এবং সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশের স্থপতি। তিনি নিজেই একটি অনবদ্য ইতিহাস। সকল অর্থেই তিনি মানুষের কাছে মহিমান্বিত-মহান ব্যক্তিত্ব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমা স্বরূপ হবেন। তাকে অবলম্বন করেই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করবো, সেবা করবো। তার সঙ্গে যোগ রেখেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হবে।’ তবে রবীন্দ্রনাথ যেমন মানুষটির খোঁজ করেছিলেন তার সন্ধান পেতে আমাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
এখন থেকে প্রায় শত বছর আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ডাক নাম খোকা। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন মুক্তিপাগল এক সংগ্রামী মানুষ। সময় যত গড়িয়েছে তত তার নেতৃত্বশৈলীর পরিচয় পেয়েছে বাঙালি জনগণ। তিনি ছিলেন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর জন্য এক ত্রাসের নাম। ছাত্র অবস্থা থেকে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আন্দোলনে যেমন তার অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হয়েছে, তেমনি তার দৃপ্ত পদাচরণা ছিল ভাষা আন্দোলনের মত জাতীয়তাবাদী চেতনার আন্দোলনেও। ধীরে ধীরে তিনি চলে এসেছেন রাজনীতির উচ্চ শিখরে। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অমানবিক অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ ছিল দিক নির্দেশনা স্বরূপ।
১৯৬৬ সাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নেতৃত্বগুণের বড় পরিচয় দিলেন ‘ছয়দফা দাবি’ উত্থাপনের মধ্যদিয়ে। যার মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর অন্যায় শাসন থেকে তিনি বাঙালী জাতিকে মুক্তির পথ দেখান। যার প্রত্যেক দফায় তিনি এদেশের মানুষেরে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ থেকে বাঙালী জাতিকে মুক্ত করার জন্য এক দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। যা বর্তমানে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নামে পরিচিত। তার দিক নির্দেশনামূলক এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠেছিল, সারাদেশে প্রতিরোধ শুরু হয়ে গিয়েছিলে। এভাবেই তিনি তার সম্মোহনী নেতৃত্বের অনন্য পরিচয় দিয়ে যান। এই মহান নেতার নেতৃত্বের পরশে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যের দেখা পায়।
বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবন কেটেছে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের নেতা। মানুষের উপর আস্থা অর্জন করার মতো মহৎগুনের অধিকারী ছিলেন এই কালজয়ী নেতা। তিনি সবসময় একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান একত্রে বসবাস করবে, পারস্পারিক সম্প্রীতির মাধ্যমে। পাশাপাশি একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার চিন্তা-চেতনা তার মধ্যে ছিল। তার রাজনৈতিক দর্শন ছিল বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলা। এজন্য তিনি স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ ডাক দেন। এই উদ্দেশ্য তিনি ২৬ মার্চ, ১৯৭২ সালে বেতার ও টেলিভিশনের ভাষণে বলেন, শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষনমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবঃ।
সারাবিশ্বে বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তাকে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে তিনি চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে সারাজীবন নির্যাতন সহ্য করেছেন। ফাঁসির দড়ি তাকে তার লক্ষ্য থেকে এক চুল ও নড়াতে পারেনি।
তার সুদক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যেতে শুরু করেছিল, তখন সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সৈন্য সপরিবার হত্যা করে এই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নেতাকে। এই ঘাতক বাহিনী ভুলে গিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। বঙ্গবন্ধুর শুধু শারীরিক মৃত্যু ঘটেছে, মৃত্যু ঘটেনি তার আদর্শের, লক্ষ্যের। তিনি তার কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন, যতদিন বাঙালি ও বাংলাদেশ থাকবে।
লেখক: মো. হাসান তারেক
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা