বিবেকই মনুষ্যত্ববোধের বাতি
বিবেক হচ্ছে একটি প্রবণতা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা অথবা অভিমত যা আমাদের ঠিক-বেঠিকের মাঝে পার্থক্য করতে সাহায্য করে। নৈতিক অভিমত মূল্যবোধ অথবা প্রথা (নীতি এবং নিয়ম) থেকে এটি উদ্ভূত হতে পারে।
মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, ‘বিবেক’ বলতে প্রায়শই বোঝানো হয় কিছু অনুভূতি যেমন, অনুশোচনার অনুভূতি যখন কোন মানুষ তার নৈতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কাজ করে এবং সততার কিংবা ন্যায়পরায়ণতার অনুভূতি যখন তার কৃতকর্ম নৈতিক মূল্যবোধের অনুগামী হয়।
তাহলে এক কথায় বিবেকের সংজ্ঞাটা মোটামুটি এমন দাড়ায়, ‘বিবেক’ মানুষের এক মূল্যবান সম্পদ। মানুষ নামক যে যন্ত্রটি পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়ায় সেই যন্ত্রটির মৌলিক মানবীয় প্রাণশক্তিই হলো ‘বিবেক’। এটি ছাড়া মানুষ কখনো মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে না। আলবত সে পশুর কাতারে নেমে আসে। সব মানুষই বিবেকসম্পন্ন। কেউ তার নিয়মিত পরিচর্চা করে, কেউ তার অবহেলা ভরে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়। বিবেকের পরিচর্চার মাধ্যমেই কোন সাধারণ মানুষ মহা-মানুষে পরিণত হয়। আবার বিবেককে ক্রমাগত অবহেলার মাধ্যমে বিবেকের অপমৃত্যু ঘটে এবং মানুষ অ-মানুষে পরিণত হয়। সমাজ ও সভ্যতায় নেমে আসে অরাজকতা, বিপর্যয়, অন্যায় ও অবিচার। যেই সমাজে মরহুম বিবেকের সংখ্যা বাড়তে থাকে সেই সমাজ পশুর খোঁয়াড়ে পরিণত হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে। যার কারণে কেউ ছোট্ট একটি অপরাধ করলে, মানুষ তাকে বলে থাকে ‘লোকটির বিবেক নাই’ অথবা ‘এটি বিবেকহীনের কাজ’।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, মানুষ ও পশুর মধ্যে তফাৎ হলো একমাত্র বিবেক। মানুষের বিবেক আছে, পশুর নেই। কিন্তু মানুষ যখন বিবেকহীন হয়ে পড়ে, তখন সে পশুর চেয়েও অধিকতর নিচে নেমে যায়। কারণ পশুরা শুধুমাত্র নিজের জঠরজ্বালা নিবারণের জন্য অন্য পশুকে শিকার করে। হিংসা-বিদ্বেষ, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা হিংসাত্মক মনোভাব চরিতার্থ করার জন্য কোন পশু অন্য পশুর উপর আক্রমণ চালায় না। কিন্তু বিবেকহীন একজন মানুষ হেন হীনতর কাজ নাই যা সে করতে পারে না।
একটি ইংরেজি ম্যাগাজিনের লিড হেডিং প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল এ রকম যে, ‘Life is the cheaper only in Bangladesh’ অর্থাৎ ‘বাংলাদেশে মানুষের জীবনই একমাত্র সস্তা।’
বিবেক রক্ষা করার জন্য প্রথমত নৈতিক শিক্ষার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য নেতৃত্বের অসুস্থ বিবেককে সর্বপ্রথম সুস্থ করে তুলতে হবে। বর্তমান বিবেকের যেই করুণ অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে সম্মিলিতভাবে নেতৃত্ব ও দেশের জনগণ উভয়ের বিবেকের পরিচর্চার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
এ সমস্ত জায়গা থেকে নৈরাজ্যকর অবস্থা দূর করে শক্তিশালী বিবেকবানদের দায়িত্ব দিতে হবে। প্রত্যেকটি মানুষ যদি তার নিজস্ব ইনস্টিটিউট তথা পরিবার ও সমাজ থেকে দায়িত্বানুভূতির শিক্ষা পায় তবে সমাজ সুন্দর হয়ে যাবে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে।
মানুষ শ্রেষ্ঠ, কারণ তাকে বিবেক দেওয়া হয়েছে। যা দিয়ে সে ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচার করবে এবং অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুম-নির্যাতন থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। এই বিবেকের কারণে মানুষ পশুর থেকে পৃথক সত্তা। মানুষ যখন নিজের পশুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয় এবং সৎভাবে তার দৈনন্দিন জীবনযাপন করে, তখনই সে ‘আশরাফুল মখলুকাত’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
দেশ-জাতি ও রাষ্ট্রের যেমন উচিত মানবাধিকার রক্ষাকল্পে বিভিন্ন আইনকানুন ও গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা, তেমনি করে দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্তব্য তাদের যায়গা থেকে নিজেদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করে নারী ও শিশু নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা। তাহলেই অসহায় নারী ও শিশুরা মানবরূপী দানবদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
আবেগ এবং বিবেক একে অপরের পরিপূরক। মানুষ জখন বড় ভাবে আঘাত পায় বা ব্যর্থ হয় তখন সে হয় অতি বিবেকবান হয় অথবা আবেগি হয়। মানুষ আবেগ আর বিবেক দিয়েই তার মনের খোরাক মেটায়।
আবেগ দেখাতে গিয়ে বিবেককে বিসর্জন দেয়া উচিৎ নয়, আবেগ থাকবে কিন্তু বিবেক অবশ্যই প্রত্যেকের থাকা উচিৎ। মানুষ মাত্রই আবেগ প্রবণ, আর অত্যধিক আবেগ প্রবণতার কারণে মানুষ প্রায়শই মারাত্মক ভুল করে বসে। কাজেই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ রেখে কাজ করে যেতে হবে।
আমরা অনেক আগেই অন্ধকার যুগ পেরিয়ে এসেছি। আমরা এখন সভ্য সমাজের মানুষ। আমরা আলোকিত সমাজের বাসিন্দা। তবুও কেন আমরা নিজেদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? এর মূলে রয়েছে অন্ধ বিবেক। আমরা অন্ধ বিবেকের বদ্ধ ঘরে থাকতে চাই না। আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ সুন্দরভাবে সাজাতে চাই। সত্যের আলোয় ভরে উঠুক আমাদের সমাজ। সত্য, সুন্দর ও স্বচ্ছতায় জেগে উঠুক বিবেক।
বিবেক মানে যে ভাল মন্দ বোঝার ক্ষমতা সেটা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই, তবে যেটা নিয়ে ভয়ঙ্কর রকমের দ্বিমত সবসময় ছিল এবং আছে সেটা হল, আসলে ভাল কোনটা আর মন্দ কোনটা। কেউ যদি একটু ভাল করে খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন এই বিবেক ব্যাপারটার মধ্যে বিরাট কিছু গোলমাল আছে। আপনার একটা জিনিষকে ভাল মনে হতে পারে, কিন্তু এটা যে আসলেই ভাল সেটার কোন গ্যারান্টি নেই। মানুষের বিবেক কখনই কন্সট্যান্ট না, এটা নির্ভর করে, time to time, place to place অনুযায়ী।
ইভটিজিং ব্যাপারটা কেমন- খুব খারাপ? আচ্ছা, মানলেন এটা খারাপ, সমাধান কই? সমাধান হল, ‘ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা বাড়িয়ে দাও’ বলছেন দেশের মাথারা, বুদ্ধিজীবীরা। এটা পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্য প্রয়োগ করেছে, তবে রেপ কেস নাকি দিনদিন বাড়ছে। কিন্তু না, ‘বিবেক’ অনেক হিসেব নিকেশ করেই কথা বলছে, তারা সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী, না বুঝে কথা বলেন না।
ইভটিজিং সমাজে নিষিদ্ধ হলেও ইভটিজিং শিখিয়ে দেয় এরকম গান গাওয়া আমাদের বিবেকের বিরুদ্ধে যায় না। একটা গান যেমন,
‘চুমকি চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে
রাগ কোর না সুন্দরী গো
রাগলে তোমায় লাগে আরো ভাল’
বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশা কিংবা যৌনতা এইসব। তবে এইসবের ফল অর্থাৎ ইভ টিজিং গ্রহণযোগ্য না। ব্যাপারটা এমন হলো, ‘পথ দেখিয়ে উসকে দিলাম, তবে হাটতে পারবে না।’
শুধু তাই না, মানুষের মধ্যে ইমোশন আছে, বিবেকের মধ্যে ইমোশন ঢুকে গেলে ভারি সমস্যা। ইমোশন ছাড়াও আছে লোভ আর ভোগ। আছে তার সংস্কৃতি। হিন্দি সংস্কৃতির অশ্লীল অংশটাকে বর্জন করার জন্য অনেকে বাংলা সংস্কৃতিতে ফিরে আসতে বলেন। কিন্তু বাংলা সংস্কৃতিতে সমস্যা নেই তা কে বলেছে? বাংলা সংস্কৃতিকে কিভাবে আমরা সঠিক রেফারেন্স হিসেবে নিচ্ছি?
একটা মানুষ কোনটাকে ভাল বলবে আর কোনটা কে খারাপ বলবে সেটা তার জীবনদর্শন আর জীবনের উদ্দেশের উপরে নির্ভর করে। আমি যখন এই নোটটা লিখছি তখন বাজে রাত ১২:০০ টা। এই রাতে একটা ছেলে অপরিচিত কিংবা তথাকথিত তার কোন জাস্টফ্রেন্ড কিংবা গার্লফ্রেন্ডের সাথে শুয়ে থাকবে নাকি নফল নামাযের জন্য আল্লাহর সামনে দাঁড়াবে এটা নির্ভর করে তার জীবনদর্শনের উপরে।
মনুষ্যত্ব হচ্ছে, a set of strengths focused on “tending and befriending others”.
মানুষকে মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন হতে হলে চিন্তা করে দেখার, ভেবে দেখার মানসিকতা থাকতে হয়। মানবিক অনুভূতি থাকতে হয়। ঔচিত্যবোধ থাকতে হয়। থাকতে হয় তার যথেষ্ট বিবেক। যুক্তিবোধ, ন্যায়পরায়ণতা এবং সততার মতো গুণ গুলো তার থাকা চাই। এছাড়া তার ত্যাগের মনোভাব, সুস্থ জীবনবোধ চর্চা এবং দূরদর্শিতার অধিকারী হতে হবে।
কোনো ভারী জিনিসকে উপরে তুলতে হলে তাকে নিচের থেকে ঠেলতে হয়। আবার উপর থেকে টানতেও হয় মাঝে মাঝে। শুধু নিচের থেকে ঠেললে তাকে আশানুরূপ উপরে উঠানো যায় না। মানব উন্নয়নের ব্যাপারে শিক্ষা সেই উপর থেকে টানা, আর সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা নিচের থেকে ঠেলা বুঝায়। অনেকে মিলে খুব জোরে উপরের থেকে টানলে নিচের ঠেলা ছাড়াও কোনো জিনিস উপরে উঠানো যায়- কিন্তু শুধু নিচের ঠেলায় বেশিদূর উঠানো যায় না। তেমনি আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষার দ্বারাই জীবনের উন্নয়ন সম্ভব। কিন্তু শুধু সমাজ ব্যবস্থার সুশৃঙ্খলতার দ্বারা তা সম্ভব নয়। শিক্ষাদীক্ষার ফলে সত্যিকার মনুষ্যত্বের ফলে মানুষ উপলব্ধি করতে পারে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ কথাটা বুলিমাত্র, সত্য।
লোভের ফলে যে মানুষের আত্মিক মৃত্যু ঘটে। অনুভূতির জগতে সে ফতুর হয়ে পড়ে। শিক্ষা মানুষকে সে-কথা জানিয়ে দেয় বলে মানুষ লোভের ফাঁদে ধরা দিতে ভয় পায়। ছোট জিনিসের মোহে বড় জিনিস হারাতে যে দুঃখ বোধ করে না, সে আর যাই হোক শিক্ষিত নয়। শিক্ষা তার বাইরের ব্যাপার, অন্তরের ব্যাপার হয়ে ওঠেনি এখনো। লেফাফাদুরস্তি আর শিক্ষা এক কথা নয়। শিক্ষার আসল কাজ জ্ঞান পরিবেশন নয়, মূল্যবোধ সৃষ্টি; জ্ঞান পরিবেশন মূল্যবোধ সৃষ্টির উপায় হিসেবেই আসে। তাই যেখানে মূল্যবোধের মূল্য পাওয়া হয় না, সেখানে শিক্ষা নেই।
শিক্ষার মারফতে মূল্যবোধ তথা মনুষ্যত্ব লাভ করা যায়; তথাপি অন্নবস্ত্রের সুব্যবস্থাও প্রয়োজনীয়। তা না হলে জীবনের উন্নয়নে অনেক বিলম্ব ঘটবে। (প্রবন্ধটি মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ গ্রন্থের ‘মনুষ্যত্ব’ শীর্ষক প্রবন্ধের অংশবিশেষ)
আজকে আমি কারো উপকার করতে পেরেছি কিনা; কারও ক্ষতির কারণ হইনি তো! এটি আমরা চিন্তাও করিনা। মজলুমের কান্না আমাকে ব্যথিত করেছে কিনা; কোনো জালিমকে সাহায্য করিনি তো!- এসব প্রশ্নের উত্তর যদি মনের আয়নায় হ্যাঁ হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবে ঘুমাতে পারি। আর যদি কিছুটা গড়মিল থাকে, তাহলে আগামীকাল থেকেই আমাদের সংশোধনের শপথ নিয়ে ঘুমানো দরকার, যা বুদ্ধিমানের কাজ।
‘মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীন’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
খুব ভালোভাবে জীবন ধারণের জন্য নয়, কোনো রকমে জীবন ধারণের জন্যও মানুষের অনেক কিছুই প্রয়োজন হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রয়োজনটা কী আসলে?
এই প্রশ্নটার জবাব পাওয়ার আগে বা এই প্রশ্নটার জবাব খোঁজার আগে স্মরণ রাখতে হবে যে, মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ একাকী জীবন যাপন করা তো অনেক দূরের কথা, চিন্তা করাও একটা বোকামি মনে হয়। ঘরে-বাইরে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তাকে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রেখে চলতে হয়। সে প্রয়োজন একজন মহৎ মানুষের যেমন থাকে, তেমনি থাকে একজন দুর্বৃত্তেরও। তবে সব মানুষেরই যদি মানুষের মতো বাঁচতে হয় তা হলে দরকার হয় মনুষ্যত্ববোধের। মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজনটা হলো মনুষ্যত্ববোধের প্রয়োজন।
কিন্তু মনুষ্যত্ববোধটা কী? এ প্রশ্নের উত্তর ঠিক কে দিতে পারবেন? স্কুলে পড়া, কলেজে পড়া না বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কেউ? নাকি অন্য কেউ?
স্কুলে পড়লে, কলেজে পড়লে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই যদি মানুষ মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন হয়ে উঠা যেতো, তা হলে তো সমাজে, দেশে এবং বিশ্বে তো কোনো সমস্যাই থাকতো না। মানুষকে মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন হতে হলে চিন্তা করে দেখার, ভেবে দেখার মানসিকতা থাকতে হয়। খুব কম সময় যা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে হাসিল করা সম্ভব হয়।
আমাদের শৈশবে, বাল্যে এবং কৈশোরে মনুষ্যত্ববোধের শিক্ষা আমাদের বাবা-মা আমাদের খুব সহজ-সরলভাবেই দিয়ে থাকেন। তারা এত কিছু আমাদের বলেন না। শুধু যেটা বলে থাকেন, তুমি কাউকে সে রকম কোনো কথা বলো না, যে রকম কথা তুমি নিজে শুনতে চাও না। তুমি কারো সঙ্গে সে রকম ব্যবহার করো না, যে রকম ব্যবহার তুমি নিজে পেতে চাও না।
শৈশবে, বাল্যে এবং কৈশোরে এভাবে মানুষকে চিন্তা করতে শেখালে এভাবে মানুষের মানসিক গঠনের কাজটা হয়ে যায়। এভাবে চিন্তা করার, অনুভব করার এবং দেখার অভ্যাসটা তারমধ্যে গড়ে ওঠে। এভাবে চিন্তা করতে শেখালে মানুষ ঔচিত্যবোধের, ন্যায়পরায়ণতার, মনুষ্যত্ববোধের শিক্ষা পায়।
কিন্তু এভাবে অনুভব করার, চিন্তা করার এবং উপলব্ধি করার শিক্ষা কি আমাদের সব পরিবারে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়? এভাবে শিক্ষা দেয়ার মানসিকতাটা কি সবার আছে? শিক্ষকদেরও সবারই কি আছে?
আমাদের শৈশবে, বাল্যকালে এবং কৈশোরে আব্বা আমাদেরকে শিখিয়েছেন কোনোভাবে কারো মনে কষ্ট দিয়ে ফেললে কাউকে কোনোভাবে আঘাত দিয়ে ফেললে, কোনোভাবে কারো ক্ষতি করে ফেললে তার কাছে মাফ চেয়ে নিতে হয়। বাবা-মায়েরা নিজেও আমাদের প্রতি কোনো অবিচার করে ফেললে কোনো ভুল করে ফেললে, আমাদেরকে কোনো কষ্ট দিয়ে ফেললে আমাদের কাছে মাফ চেয়ে নিতেন। এভাবে কারো মনে কষ্ট দিয়ে ফেললে, কারো কোন ক্ষতি করে ফেললে, কোনো ভুল করে ফেললে মাফ চেয়ে নেয়ার শিক্ষা আমরা অনেকে আমাদের শৈশবে, বাল্যে এবং কৈশোরে পেয়ে থাকি।
এসব শিক্ষা আমাদের সুস্থ জীবনবোধ নিয়ে চলার পক্ষে সহায়ক হয়। এরকম শিক্ষা আমাদের সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা থেকেও পেতে পারি আমরা। উপমহাদেশের অনেক গুণীজন আছেন যারা এসব বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছেন, সেসব লেখাও আমাদের আদর্শ হতে পারে।
এভাবে শিশু, বালক-বালিকা এবং কিশোর-কিশোরীদের শেখানোর দায়িত্ব পরিবারের লোকেদের, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের, আত্মীয়-পরিজনদের এবং এলাকার মানুষদের কেবল নয়, সব মানুষেরই। শিক্ষার শুরুটা বাল্যকাল থেকে যেহেতু, তাই শিশুদের মনুষ্যত্ববোধের শিক্ষাটা আগে দেওয়া প্রয়োজন। যে শিক্ষা কোথাও কিনতে পাওয়া যায় না, অনেক সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকেও তা পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে।
সন্তানকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হলে সন্তানের অভিভাবককেও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন হতে হয়। তেমনি শিক্ষার্থীকেও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, ঔচিত্যবোধসম্পন্ন এবং সৎভাবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষকদেরকেও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, ঔচিত্যবোধসম্পন্ন, সৎ ও সংবেদনশীল মনের হতে হয়। আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে যে, বুনে আমড়া গাছে হিমসাগর আম হয় না।
গত ২রা ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখ রবিবার ঢাকার ভিকারুন্নিসা নুন স্কুলের প্রধান শাখার ইংলিশ ভার্সনের দিবা বিভাগের নবম শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী যখন ১২৮ নম্বর রুমে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে বার্ষিক পরীক্ষা দিচ্ছিল। পরীক্ষা চলাকালে সে সময়ে দুই পরিদর্শক অরিত্রীর কাছ থেকে মোবাইল ফোন উদ্ধার করেন। মোবাইল ফোন পাওয়ার পর উত্তরপত্রের সঙ্গে মোবাইলে ধারণ করা পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসের অংশটুকুর মিল আছে কিনা সে বিষয়ে আদৌ নিশ্চিত না হয়েই তারা ভিত্তিহীন এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, অরিত্রী নকল করছিল। মোবাইল ফোন ও উত্তরপত্র কেড়ে নিয়ে তারা অরিত্রীকে পরীক্ষার হল হতে বের হয়ে যেতে বলেন এবং পরের দিন প্রভাতী শাখাপ্রধান জিনাত আখতার এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌসের সঙ্গে দেখা করতে বলেন।
অরিত্রীর বিরুদ্ধে কিন্তু ইতোপূর্বে কখনো এরকম কোনো অভিযোগ ছিল না।
এ বিষয়ে প্রথম কথা হলো, কোনো শিক্ষক যদি যথার্থই উপযুক্ত শিক্ষক হন তা হলে তিনি ক্লাসেই বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনে সুস্পষ্ট ধারণা পোষণ করার সুযোগ করে দিতে পারেন। পড়াবার নিয়মই হলো বিষয়টি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মনে কৌতূহল বা জানার আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে এবং এরপর তাদের জানার বা বোঝার প্রয়োজন মেটানোর বন্দোবস্ত করতে হবে। তাহলে জানার এবং শেখার ব্যাপারটা তাদের কাছে আনন্দদায়ক হবে। এরপর কেউ নকল করবে এরকম কোনো সন্দেহ পোষণ করার কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। ক্লাসে ভালোভাবে পড়ালে নকল করার চিন্তা কোনো শিক্ষার্থীর মাথায় আসার কথা নয়।
বিশেষ করে যারা শিশুদের, বালক-বালিকাদের এবং কিশোর-কিশোরীদের পড়াবার দায়িত্ব পালন করেন, তাদের অবশ্যই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ও সংবেদনশীল মনের হওয়া দরকার। গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে সবদিক খতিয়ে দেখার মানসিকতাও শিক্ষকদের থাকা দরকার।
একমাত্র মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব এই অমানবিকতার অন্ধকার দূর করা। মানবিক সমাজপ্রতিষ্ঠা করতে হলে চাই মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ। এই বোধটুকু সৃষ্টি করতে হলে সর্বত্রই অতি গুরুত্বসহকারে শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাবলীল চর্চা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবেই সৃষ্টি হবে মানুষের মধ্যে যুক্তিবোধ। আর সেই যুক্তিবোধ থেকেই সৃষ্টি হবে সুন্দর এবং নির্মল পরিবেশ। সেই ক্ষেত্র যতক্ষণ না তৈরি হবে, ততক্ষণ আমরা মানবিক সমাজ গঠনে সফলকাম হব না।
লেখক: হামিদুর রশিদ জামিল
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
e-mail: hamidurrashid766330@gmail.com