প্রযুক্তির যুগে আমাদের নৈতিকতা
বর্তমানের যুগকে বলা হয় তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। এ প্রযুক্তির যুগে আমাদের জীবন যাত্রাকে সহজ ও প্রাণবন্ত করেছে! এই প্রযুক্তি আমাদেরকে সব কিছু হাতের মুঠে এনে দিয়েছে। বর্তমানে প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার আমাদের সমাজ জীবনে উন্নতি সাধন করেছে এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আধুনিক জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে প্রযুক্তি প্রভাব ফেলছে, ফলে পাল্টে যাচ্ছে কার্যপদ্ধতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়া। আধুনিক প্রযুক্তির মোবাইল-ফোন, কম্পিউটারের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবটিক্স, জেনেটিক্স, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের সূচনা বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধে কেড়ে নিয়েছে। সভ্যতার উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির অবদান অপূরণীয়। কিন্তু আমরা কি কখনো অনুধাবন করে দেখেছি যে প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের সমাজের মানুষ গুলোকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতার ফলে আমাদের সমাজে আজ সৃষ্টি হয়েছে অস্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তাহীনতা। নৈতিক অধঃপতনে পতিত হয়েছে আমাদের সমাজ। সহজতর যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বাস। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ইত্যাদির মাধ্যমে অবাধ যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের বর্তমান সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ কারণ হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অনেকাংশে দায়ী।
অত্যধিক ফেসবুক ব্যবহার বিবাহবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। ফেসবুকের কারণে স্বামী সন্দেহ করছেন স্ত্রীকে আর স্ত্রী স্বামীকে সন্দেহ করছেন। বিশ্বাস হারাচ্ছেন একে অন্যের প্রতি।
বর্তমানে অধিকাংশ তরুণরা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার ব্যবহার করেন। সকলের হাতেই মোবাইল। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারে আগ্রহটা বেশি। স্মার্টফোনে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে বিশ্বের সকল তথ্য এখন ‘হাতের মুঠোয়’। আমাদের দেশের যুবারা ইন্টারনেট ব্যবহারে মূলত বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা ইমেইল ও জিমেইল আলাদা জিনিস মনে করেন। এছাড়াও অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা ইমেইল কি জিনিস সেটাই জানেন না।
ইন্টারনেটের বিশাল তথ্যভাণ্ডারের ধারেকাছেও ঘেঁষে না বেশিরভাগ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা। এমনকি ব্লগ সম্পর্কেও বেশিরভাগেরই ধারণা নেই। অথচ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৩৯ লাখ। যার অধিকাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি আপলোড,স্ট্যাটাস, চ্যাটিং এই সীমাবদ্ধ।
প্রযুক্তির এ অপব্যবহার তাদের ব্র্যান্ড, ইমেজ, ও গ্লামারের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করে। ফলে এটির অনুকরণে যুবসমাজ ভালমন্দের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। মানুষের জীবনযাত্রার মান সহজ ও স্মার্ট করার পেছনে ইন্টারনেট, ইউটিউব, ভাইবার, ফেসবুকসহ প্রযুক্তির আরো অনেক মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও এর আবার বিপরীত ভূমিকাও লক্ষ্য করা যায়। যা যুবসমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ।
ইন্টারনেট, ইউটিউব, পর্ণগ্রাফি আসক্তিতে উন্নত দেশগুলোর প্রায় ৬৫% যুবসমাজ (১২-১৮ বছর) যৌন হয়রানি ও ধর্ষণসহ বড় বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। যা সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ এমনকি পর্ণ আসক্তিতে প্রতি বছর আমেরিকার স্কুল পড়ুয়া ২,৮০,০০০ শিক্ষার্থী গর্ভবতী হচ্ছে যা পুরো সমাজ ও একটি রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। (সূত্র: ন্যাশনাল ক্রাইম প্রিভেনশন সার্ভে)। আমাদের দেশে এমন ঘটছে না তা কিন্তু নয়।
বর্তমান আধুনিক যুগের তথা কথিত প্রেম, পরকীয়া, নগ্নতা। অতঃপর খুন , আত্মহত্যা হচ্ছে এসবের পরিণতি।
পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয়ের এমন নির্মম পরিণতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। একাধিক সন্তানের জননীর সাথে কলেজের ছাত্রের পরকীয়ায় স্বামী খুন। শিক্ষক/শিক্ষিকার সাথে শিক্ষার্থীর প্রেম, যৌন হয়রানি । মা- বাবার পরকীয়ার কারণে সন্তান হত্যার খবর এখন অহরহ। পরকীয়ার কারণে পারিবারিক, সামাজিক অস্থিরতা, ঝগড়া, মারামারি এবং নানাবিধ অনাকাঙ্খিত ঘটনা দিন দিন বাড়ছে নতুন নতুন মাত্রায়। এর সূত্র ধরে খুনের ঘটনায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন তাদের সন্তানদের নিয়ে।
প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার সামাজিক অবক্ষয় অনাচার বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রযুক্তি সমাজে নানামুখী চাহিদা এবং ভোগের আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করছে। পাশাপাশি মা-বাবার সন্তানদের প্রতি মনোযোগের অবহেলা, ধর্মীয় এবং নৈতিকতার চর্চার অভাবে ছড়িয়ে পড়ছে নানাবিধ অনাচার। বিপরীতক্রমে নিয়ন্ত্রণহীন প্রযুক্তির কল্যাণে পর্নোগ্রাফিসহ অশ্লীলতা এবং যৌনতায় ভেঙে যাচ্ছে ধর্মীয়,সামাজিক, পারিবারিক, এবং ব্যাক্তি কেন্দ্রিক নৈতিক মূল্যবোধ।
কথিত ওয়েস্টার্ন কালচার অনুসরণীয় আমাদের আধুনিক সমাজের নামে লজ্জাহীনতা, অবাধ মেলামেশা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তরুণ-তরুণীরা জড়িয়ে পড়ছে অনৈতিক সম্পর্কে।
এ রকম অগণিত অপরাধমূলক কাজ আমাদের সমাজের নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। যার দরুন একটি দেশের নাগরিকদের আর্থিক, সামাজিক ও মানসিক অবক্ষয়ের হার বাড়ছে। এর প্রতিকার হিসেবে ইন্টারনেট ও অনন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই ।
এখনই আমাদের এই ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত।একটি সঠিক ধর্মীয় আদর্শ ধারণ করা উচিত যার মাধ্যমে আমাদের যুবসমাজ তাদের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হবে এবং তারা হয়ে উঠবে এক একজন, মানবতার কল্যাণে-দেশের কল্যাণে, নিবেদিত প্রাণ। প্রকৃত ধর্মের শিক্ষার পাশাপাশি সঠিক প্রযুক্তির শিক্ষা আমাদের দেশ ও জাতিকে সম্বৃদ্ধি করে তুলবে।
লেখক: হাবিবুল্লাহ আল মারুফ
শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: habibullahjkkniu@gmail.com