১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৩৭

হুমায়ূন আহমেদের লেখায় ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রয়োগ ও প্রাসঙ্গিকতা

ড. নাহিদা নাহিদ  © টিডিসি সম্পাদিত

অনেকে বলেন, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য বোঝার জন্য কোনো জটিল তত্ত্বের দরকার হয় না। তাঁর গল্পে জীবনের এত সাধারণ সুখ-দুঃখ, ভালোবাসা ও বেদনা ধরা পড়ে যে পাঠক নিজেই সেগুলো অনুভব করতে পারে। তবে এটাও অস্বীকার করা যায় না মানুষের অন্তর্জগৎ, অবচেতন মন, একাকিত্ব আর অজানার ভয়কে বোঝাতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখায় বহু জায়গায় এক নিঃশব্দ সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব। হুমায়ূনের চরিত্ররা হিমু, মিসির আলি, কিংবা অন্যরা প্রতিটিই যেন ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্বের ভিন্ন ভিন্ন দিকের প্রতিনিধি। পাত্র-পাত্রীর লিবিডো চেতনা, জীবনবিমুখতা, অবচেতন মন, মানসিক ব্যাধি বা অবদমিত আকাঙ্ক্ষা—সব জায়গায়ই হুমায়ূন যেন ফ্রয়েডের মনোচিকিৎসার ছোঁয়া দিয়েছেন।

হিমু যদি প্রকৃতির ভেতরে এক রহস্যময় ‘super natural power’ খুঁজে পান, তবে তার একেবারে বিপরীতে মিসির আলি সেই সব অতিপ্রাকৃত ঘটনার ব্যাখ্যা করেন যুক্তি ও মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে। ফ্রয়েডের ‘psychoanalysis’ যেন তাঁর হাতের যাদুর মতো। ‘সঙ্গিনী’ গল্পে হুমায়ূন আহমেদ সরাসরি টেনেছেন ফ্রয়েডের Interpretation of Dreams তত্ত্ব। সেখানে তিনি precognition dream বা ভবিষ্যৎবাণীমূলক স্বপ্নের ধারণাকে পাঠকের সামনে হাজির করে আবার তা নাকচও করেছেন। ফলে পাঠকের মনে তৈরি হয়েছে এক মিষ্টি বিভ্রান্তি। ‘দেবী’ উপন্যাসে রানুর ভয় ও মানসিক সংকটের সমাধান এসেছে psycho-trauma তত্ত্বের মাধ্যমে। ‘কফিল’ গল্পে লতিফার মানসিক রোগ বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হয়েছে ফ্রয়েডীয় hysteria তত্ত্ব।

‘আমিই মিসির আলি’ উপন্যাসে neurosis আক্রান্ত সুলতানের চিকিৎসায় হুমায়ূন ব্যবহার করেছেন psycho-shock therapy, আর ‘আমি এবং আমরা’ উপন্যাসে মুশফেকুর রহমানের মানসিক টিকে থাকার প্রক্রিয়ায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন defense mechanism তত্ত্ব। সব মিলিয়ে বলা যায়, মিসির আলি শুধু এক কল্পিত চরিত্র নন, তিনি হুমায়ূন আহমেদের ফ্রয়েডীয় জগতের এক জীবন্ত প্রতীক। তাঁর যুক্তি, মনোচিকিৎসা, অবচেতন অনুসন্ধান—সবকিছুতেই স্পষ্ট ফ্রয়েডের ছায়া। 

মিসির আলি ছাড়াও হুমায়ূন সাহিত্যে যৌনতার যে বিচিত্র অভিমূখ সেখানেও ফ্রয়েড অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ফ্রয়েড বলেছেন: "It is the fate of all of us, perhaps, to direct our first sexual impulse towards our mother and our first hatred and our first murderous wish against our father."

হুমায়ূন আহমেদের 'চক্ষে আমার তৃষ্ণা' উপন্যাসে তরুদের বাসার ভাড়াটিয়া প্রৌঢ় ওসমানের প্রতি তরুর যে ধরনের রহস্যময় আকর্ষণ লক্ষ করা যায় তা ফ্রয়েডের ‘ইডিপাস গূঢ়ৈষা’ (Oeidipus complex) দ্বারা ব্যাখ্যাযোগ্য। ফ্রয়েড বিশ্লেষকদের মতে, যেহেতু মেয়েদের ইডিপাস-গূঢ়ৈষার সমাধান অসম্পূর্ণ থাকে, এজন্য তারা একজন পিতৃকল্পকেই তাদের ভালবাসার বস্তুরূপে কামনা করে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে এরূপ গূঢ়ৈষা লক্ষ করা যায় 'নীল অপরাজিতা' উপন্যাসের পুষ্প, 'দাঁড়কাকের সংসার কিংবা মাঝে মাঝে তব দেখা পাই' উপন্যাসের লিপি ও 'রুমালী' (১৯৯৭) উপন্যাসের রুমালীর মধ্যে। উপন্যাসে তাদের কৈশোরিক প্রেম পরিপূর্ণ সমর্পিত হয়েছে পিতার বয়সী কোনো পুরুষের প্রতি। 

পারিবারিক প্রতিবেশ থেকে যৌনতা বিকাশের ব্যাখ্যায় ফ্রয়েডীয় মতবাদ হতে আরও জানা যায়, সবরকম স্নেহ-ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব, ভক্তিভাব আমাদের মূল যৌন-প্রবৃত্তি (Libido) হতে উদ্ভূত। সহজাত কামপ্রবৃত্তিতে যার প্রবর্তন, বিকাশের ধারায় তারই উত্তরণ। এই সহজাত যৌনতায় প্রাক-ইডিপাস পর্যায়ে ছেলেদের কাছে মা-ই থাকে যাবতীয় সম্মান-ভালোবাসার পাত্রী। কিন্তু লিঙ্গকাম পর্যায়ে এসে সে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের যৌনজীবন সম্পর্কে ধারণা পায় এবং নিজের ভেতরেও মায়ের প্রতি যৌন-আকর্ষণ অনুভব করে। কিন্তু তাদের এই যৌন-আকাঙ্ক্ষা সরাসরি অজাচারের মুখে পড়ে বলে তার নির্জ্ঞান মনের যৌন-তাড়না দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। ফলে সন্তানের একটি ধারা সজ্ঞানে মাকে স্বর্গের দেবী রূপে কল্পনা করে এবং মা, বোন ও মাতৃসমা মহিলাদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা-সম্মান পোষণ করে। আর অপর একটি ধারা নির্জ্ঞান মনশ্চিত্রে মাতৃরূপের প্রতি নিষিদ্ধ কামসুখের আকর্ষণ অনুভব করে। পরিপ্রেক্ষিতে সে বিবেকতাড়িত হয়ে এমন মেয়েদেরই আকর্ষণীয় মনে করে যাদের আচার-আচরণ মাতৃস্বভাবের বিপরীত, যার সম্পর্কে কোনো কুৎসা আছে কিংবা অনুগত যৌন-সঙ্গী হিসেবে যে বিশ্বাসযোগ্য নয়, এক কথায়, যাদের আচার-ব্যবহার, জীবনযাত্রার ধরন কিঞ্চিৎ ভিন্নপ্রকৃতির। ফ্রয়েডের নর-নারীর এইরূপ আকর্ষণকে দেবী-পতিতা গূঢ়ৈষা বা Madonna-Whore complex বলে অভিহিত করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের যেসমস্ত উপন্যাসে মাতৃস্থানীয়দের প্রতি প্রেমাসক্তির প্রয়োগ দেখা যায় তার মধ্যে অচিনপুর উপন্যাস উল্লেখযোগ্য। এ উপন্যাসে রঞ্জু ও নবু শৈশবে এলাচি বেগম বা লাল বউয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে। লালবউ সম্পর্কে রঞ্জুর মামি ও নবুর বড় ভাবি। আবার লিলুয়া বাতাস (২০০৬) উপন্যাসে জহির তার ফুপু নীলার প্রতি প্রেমাসক্ত। তাঁর প্রতি জহিরের ‘দেবী-পতিতা গূঢ়ৈষা’ হওয়ার কারণ তার এই সৎ ফুপু নাটকের এক্সট্রা চরিত্রের অভিনেত্রী এবং ইন্টারনেটে তার গোপন সঙ্গমদৃশ্য প্রকাশিত। 

বিপরীত দিক থেকে সন্তানের প্রতি মা বা মাতৃস্থানীয় কেউ যখন অবচেতনে যৌন-আকর্ষণ বোধ করে ফ্রয়েডীয় ভাষায় তাকে বলা হয় Jocasta complex । হুমায়ূন আহমেদের 'মন্দ্রসপ্তক' উপন্যাসে টুকুর প্রতি তার ছোট চাচি নিনির যৌন-উত্তেজক আচরণকে Jocasta complex ই বলা যায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি নর-নারীর স্বাভাবিক প্রণয়বোধ; ফ্রয়েডের ভাষায় যার নাম ‘লিবিডো’ বা ‘কামতাড়না’ হুমায়ূনের চোখে তা ‘রূপজ আকর্ষণ’। ফ্রয়েড মনে করেন, মানুষের শরীরের কামোদ্দীপক অংশ (জননেন্দ্রিয়সমূহ) সুন্দরের সহজাত উৎস এবং আকর্ষণের কেন্দ্রস্থল। কিন্তু নানাবিধ সংস্কারের কারণে মানুষ সেই সহজাত সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ প্রকাশ করতে পারে না। ফলে কাম-আকর্ষণকে প্রসারিত ভাবনায় এনে সমস্ত শরীরকেই এক বৃহৎ কামোদ্দীপক উপকরণ ধরে নন্দনতাত্ত্বিক ভাষায় (sublime) তাকে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে গোবিন্দলাল রোহিণী সম্পর্কে বলে ‘এ রূপতৃষ্ণা, এ স্নেহ নহে- এ ভোগ, এ সুখ নহে; এ মন্দার ঘর্ষণপীড়িত বাসুকিনিঃশ্বাসনির্গত হলাহল, এ ধন্বন্তরিভাণ্ডনিঃসৃত সুধা নহে।’ আর এসময়ে এসে হুমায়ূন আহমেদের ‘এই শুভ্র এই’ উপন্যাসে ‘অদ্ভুত সুন্দর ছেলেমানুষ ধরনের যুবক’ শুভ্রকে দেখে রুনুর ‘কেমন জানি লাগে’ অথবা সে ‘এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব’ করে। মূলত, তাদের এ রূপোন্মত্ততা বা অস্বস্তির সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে দৈহিক সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে অবচেতন মনে সৃষ্টি হওয়া গোপন যৌন-আকাঙ্ক্ষা।

ফ্রয়েড মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে (Libido) প্রধান দুইটি ভাগে ভাগ করেছেন তন্মধ্যে প্রেমবৃত্তি (Love instinct) বা এরস (Eros) জীবনমুখী বলেই এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সুখভোগ ও বংশরক্ষার প্রসঙ্গ। হুমায়ূন আহমেদের 'মিসির আলির চশমা' উপন্যাসে অধ্যাপিকা শায়লার 'Impotent' (নপুংসক)  স্বামী হারুনকে রেখে জালাল নামের এক যুবকের সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি জীবনমুখী চেতনার অংশ। ফ্রয়েডের আরো একটি তত্ত্ব হুমায়ূন সাহিত্যের জন্য বেশ প্রযোজ্য। নর-নারীর এক ধরনের একমুখী প্রেম ভাবনার কথা বলেছেন ফ্রয়েড। যাকে বলা যায় অন্যাশ্রয়ী (Anaclitic) বা সম্পর্ক-অভিমুখী প্রেম। এ প্রেমে ব্যক্তির ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেশি থাকে। হুমায়ূন আহমেদের ‘আশাবরী' উপন্যাসের দুলু, 'সাজঘর' উপন্যাসের পুষ্প, 'একজন মায়াবতী'  উপন্যাসের মনজুর, 'ময়ূরাক্ষী' উপন্যাসের রূপা, 'বৃষ্টি ও মেঘমালা' উপন্যাসে লীনা, 'যদিও সন্ধ্যা' উপন্যাসের আনিকা, 'কোথাও কেউ নেই' উপন্যাসের বাকেরের নাম এই অন্যাশ্রয়ী প্রেমের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ অনুযায়ী, অধিকাংশ স্নায়ুবিকার বা নিউরোসিসের পেছনে রয়েছে অবদমন (repression), যার প্রকাশ ঘটে নানারূপ বিকৃতির মাধ্যমে। বিচিত্র বিকৃতির মধ্যে আবার একটি উল্লেখযোগ্য বিকৃতি হচ্ছে ঈক্ষণকাম, প্রচ্ছন্নরতি বা Voyeurism। অন্যের যৌনতা দেখে আনন্দ উপভোগের মাধ্যমে এই বিকৃতি ঘটে। ফ্রয়েড যাকে জার্মান ভাষায় লিখেছেন 'Schaulust',  বা 'Pleasures to look.'। হুমায়ূনের 'জনম জনম' উপন্যাসে যৌন অবদমিত কিশোর টুকু প্রায়ই নিজের পরিবার ছেড়ে এতিম-বোবা পরিচয়ে ছুটে যায় দুর্যোগকালে আশ্রয় পাওয়া এক অপরিচিত বস্তিঘরে। কারণ, ওখানে আবছা অন্ধকারে এক নববিবাহিত দম্পতির যৌনক্রিয়া দেখা যায়। হুমায়ূন উপন্যাসে এরূপ মনোবিকারের মধ্যে  যৌন রসিকতাও রয়েছে। যৌন রসিকতা করার অভ্যাাস যৌন অবদমনের ফলে সৃষ্টি হওয়া এক ধরনের বাতিক। ফ্রয়েডের মতে, স্বপ্ন যেমন বিকৃত রূপে আমাদের অচরিতার্থ আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে, যার সঙ্গে আমাদের আসল আকাঙ্ক্ষার সহজে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না, যৌন রসিকতাও আমাদের অবদমনের ফলে নির্জ্ঞান মন তৈরি করে, যা আমাদের অচরিতার্থ আকাঙ্ক্ষার এক প্রকার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। যৌন রসিকতা করার প্রবণতা বৃদ্ধদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কেননা বৃদ্ধরা প্রায়শই সঙ্গীহীন অথবা সমাজস্বীকৃত সঙ্গীর প্রতি মানসিকভাবে বিরূপ। তাদের যৌনকর্ম চরিতার্থ করার ক্ষেত্র সীমিত বলে অবদমিত মন তাদেরকে নিষিদ্ধ পথে বিকৃত আনন্দ লাভে উৎসাহিত করে । 'অপেক্ষা' উপন্যাসে ইমনের বৃদ্ধ বিধবা দাদি ও 'লীলাবতী' উপন্যাসে সিদ্দিকুরের দাদির নাতি কিংবা নাতবউদের সঙ্গে অশ্লীল কথা বলার বিষয়টি   এ পর্যায়ে পড়ে ।

হুমায়ূন সাহিত্যে যৌন-বিকারের রয়েছে বিচিত্র রকমভেদ, তার মধ্যে একটি হলো ধর্ষকাম প্রবণতা। চক্ষে আমার তৃষ্ণা উপন্যাসে সঞ্জুর দুলাভাই জামান চরিত্রটি যৌন-ধর্ষকামী। ফ্রয়েড মনে করেন, যৌন-ধর্ষকামে ‘অনেক সময় বাস্তব পীড়নের দরকার হয়তো পড়ে না— পীড়নের দৃশ্য কল্পনা করেই কামভাব উদ্দীপিত হতে পারে বা এমনকি কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থও হতে পারে।’ একারণে জামানকেও দেখা যায়- সে তার স্ত্রী শায়লা সম্পর্কে তার আপন ভাইয়ের কাছে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে বিকৃত আনন্দ লাভ করছে। মূলত হুমায়ূন আহমেদ ফ্রয়েডকে অতি স্বাভাবিকতায় গ্রহণ করেছিলেন বলেই তাঁর লেখায় মনঃসমীক্ষণ, অবদমন, লিবিডো ও নির্জ্ঞান মনস্তত্ত্ব কোনোরূপ ভারী হয়ে ওঠেনি এবং পাঠকও তাকে গ্রহণ করেছে সহজ স্বাভাবিক ছন্দেই; আর এখানেই হুমায়ূনের অনন্য শিল্পীসত্তা, মনস্তাত্ত্বিক প্রজ্ঞা ও বর্ণনাশৈলীর স্বাতন্ত্র্য।

ড. নাহিদা নাহিদ: কথাসাহিত্যিক ও সহযোগী অধ্যাপক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়