২৭ অক্টোবর ২০২৫, ২২:৪২

আবুল কালামের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়, প্রশাসনিক হত্যা

আতিক হাসান  © টিডিসি সম্পাদিত

রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় ফুটপাত ধরে হাঁটছিলেন আবুল কালাম আজাদ। বয়স তার ৩৫। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন(?) হিসেবে মেট্রোরেলের ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে তার ওপর এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনাটি ঘটে রবিবার (২৬ অক্টোবর, ২০২৫)। 

কাকতালীয়ভাবে ৭ বছর পূর্বে একই দিনে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) ও বিভাগের এক অনুজ রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় অবস্থানকালে একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়া রডের আঘাতে মৃত্যুবরণ করে। দুটি ঘটনার ক্ষেত্রে ‘কাকতালীয়’ শব্দটির ব্যবহার সম্ভবত যথার্থ হলো না। কেননা, আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত এমন দুর্ঘটনা (?) ঘটছে। নির্মাণাধীন ভবন থেকে রড পড়ে, ঢাকনা খোলা ম্যানহোলে পড়ে, ওপর থেকে গার্ডার পড়ে, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও জরুরি নির্গমন পথের ব্যবস্থাহীন ভবনে আগুনে পুড়ে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাবলি খুবই সাধারণ ও নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

যা-ই হোক, পাঠক হয়তো লক্ষ্য করেছেন, ‘অদৃষ্টের লিখন’ ও ‘দুর্ঘটনা’ শব্দ দু’টির পাশে প্রথম বন্ধনীর মাঝে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশ্নবোধক চিহ্ন ব্যবহারের কারণ হচ্ছে, আমরা কি আবুল কালামের মৃত্যুকে (এবং এর মতো ঘটনাবলিকে) অদৃষ্টের লিখন বা দুর্ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করব? না-কি এ ঘটনাকে অপরাধ ও হত্যা হিসেবে বিবেচনা করব?

একটি ঘটনাকে দুর্ঘটনা বা অদৃষ্টের লিখন হিসেবে গণ্য করা যায় শুধু তখনই, যখন সে ঘটনার ক্ষেত্রে মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ধরুন, একজন ব্যক্তি সব নিয়ম-কানুন মেনে নিরাপদ গতিতে বাইক চালাচ্ছেন; তার নিকট প্রয়োজনীয় সব সনদ ও নিবন্ধনের ডকুমেন্টস রয়েছে, তিনি মাথায় হেলমেট পরে আছেন। চলার পথে হঠাৎ তার বাইকের চাকার সামনে বিড়াল এসে পড়ল, তিনি ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেলেন; তার বাইক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মানবশিশুকে আঘাত করল এবং শিশুটি মৃত্যুবরণ করল। এ ঘটনাটিকে আমরা দুর্ঘটনা হিসেবেই চিহ্নিত করব এবং অদৃষ্টের লিখন বলে মেনে নেব।

অন্যদিকে যদি কারও দায়িত্বে অবহেলা, অসততা ও দুর্নীতির কারণে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা নিহত হয়, তবে তা দুর্ঘটনা বা অদৃষ্টের লিখন হিসেবে নয়, বরং অপরাধ ও হত্যা হিসেবে বিবেচিত হবার দাবি রাখে। আবুল কালামের মৃত্যুকে আমরা দুর্ঘটনা বলতে পারি না। এটি রীতিমতো হত্যাকাণ্ড। এটি এমন কোনো ঘটনা নয় যার ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। মেট্রোরেলের কার্যক্রম পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ রয়েছে; এ কাজের জন্য জনগণের প্রদেয় কর থেকে রাষ্ট্র তাদের বেতন দিয়ে থাকে। কর্তৃপক্ষ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছে কি-না, তার ওপর নির্ভর করে আবুল কালামের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা না-কি হত্যা হিসেবে পরিগণিত হবে।

আমরা দেখতে পাই, মেট্রোরেলে ব্যবহারের পূর্বেই বুয়েট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল যে বিয়ারিং প্যাডগুলো মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করতে যাচ্ছে, তার গুণগত মান যথাযথ নয়; অর্থাৎ নিম্নমানের, এবং এসব বিয়ারিং প্যাড ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। বুয়েট কর্তৃপক্ষের কথা আমলে না নিয়ে সেসব মানহীন বিয়ারিং প্যাডগুলোই ব্যবহার করা হয়। এক বছর পূর্বে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে, ফার্মগেট এলাকাতেই মেট্রোরেলের ৪৩০ নম্বর পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। তখন অবশ্য কেউ হতাহত হয়নি, তবে মানহীন বিয়ারিং প্যাডের বিষয়টি সামনে এসেছিল।

এরপর দীর্ঘ এক বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এসব মানহীন বিয়ারিং প্যাডের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি, যদিও দুর্ঘটনা(?) সংঘটিত হবার শঙ্কা ছিল। সেই শঙ্কা বাস্তব রূপ ধারণ করল একজন মানুষের জীবনহানির মাধ্যমে। কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও অসততার ফলে মৃত্যু হলো আবুল কালামের; পিতা-মাতা হারালেন সন্তান, একজন নারীকে বৈধব্য বরণ করতে হলো, সন্তানকে হতে হলো এতিম।

সংবাদমাধ্যমের খবর পড়ে জানতে পেরেছি, আবুল কালাম আজাদের (৩৫) স্ত্রী আইরিন আক্তার বলেছেন, তার ছেলেটার বয়স ৪ বছর, মেয়ের ৩। বাচ্চা দুটি তাদের বাবাকে হারাল। সেটার ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে? 

নিহত আজাদের স্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা মৃত্যু নয়, হত্যা। এটা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের অবহেলা। টাকা বা চাকরি দিয়ে ক্ষতিপূরণ হবে না। এই ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অবহেলায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আবুল কালামের মৃত্যু কেবল এক ব্যক্তির নয়, বরং আমাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতীক। এ ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে, কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা, জবাবদিহিতার অভাব ও দুর্নীতির সংস্কৃতি কীভাবে একটি জীবন কেড়ে নিতে পারে। রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারে, তবে সেই রাষ্ট্রের উন্নয়ন কেবল কংক্রিটের স্তূপে সীমাবদ্ধ থাকে, মানবিকতার ভিত্তি সেখানে অনুপস্থিত থাকে। মেট্রোরেলের মতো একটি আধুনিক প্রকল্পে নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার, আগের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করা, এবং পরবর্তীতে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া—সবকিছুই আমাদের শাসনব্যবস্থার গভীর ত্রুটি ও অবহেলার পরিচায়ক। 

যার ফলে আবুল কালামের মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি পরিকল্পিত অবহেলার ফল, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধের শামিল। এখন সময় এসেছে এমন প্রতিটি ঘটনাকে  ‘অদৃষ্টের লিখন’ নয়, বরং ‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বিচারযোগ্য পরিণতি’ হিসেবে দেখতে ও বিচার করতে। অন্যথায়, আগামীকাল হয়তো আরেকজন আবুল কালাম এই নগরের ফুটপাতে হাঁটতে গিয়ে প্রাণ হারাবেন। 

আতিক হাসান: লেখক ও শিক্ষক