রমযানের এক বিশেষ আমল: সালাতুত তারাবীহ
রমযান মাসে দিনের বেলা সিয়াম আর রাতে কিয়াম, এ দু’টি বিষয়ই অবশ্য পালনীয় এবং এ মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রোযা রাখলে যেমন মরীচিকা পরা অন্তরের গুনাহ মোচন হয় ঠিক তেমনি ক্বিয়াম তথা তারাবীহর নামাজ আদায় করলে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল সম্ভব হয়। ইবাদতের এ বসন্তকালে রোযা রাখার পাশাপাশি তারাবীহর নামাজ পড়া জরুরী এমনকি অধিক গুরুত্বের কারণে এটিকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলা হয়েছে।
রাসূলে কারিম (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পরকালীন প্রতিদান কামনায় রমযান মাসের রাতে ক্বিয়াম করবে (তারাবী পড়বে ইমাম নববী র. মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে লিখেছেন)তার অতীত জীবনের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (বুখারী ১৯০১,মুসলিম ৭৫৯ নং হাদীস)।
তারাবীহর পরিচয়: এটি আরবী শব্দ।যেটি ‘তারবিহাতুন’ এর বহুবচন। অর্থ-আরাম, প্রশান্তি বা বিরতি দেয়া। রমযান মাসে এশার নামাজের পর বিতর নামাজের আগে অতিরিক্ত যেই সুন্নাত নামাজ পড়া হয় তাকে তারাবীহর নামাজ বলে।
নিয়ম হলো— দুই রাকাত অন্তরন্ত সালাম ফিরানো হবে। একে কিয়ামে রমাদানও বলা হয়। (কামুসূল ফিকহ ২য় খন্ড-৪৪৮ পৃ.)। একটি বিষয় সুস্পষ্ট, সুন্নাত ও নফলে সাধারণত জামা’আত নিষিদ্ধ কিন্তু এই নামাজে জামা’আত হয় তার মানে নফলের চেয়ে এর গুরুত্ব ঊর্ধ্বে।
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সা. নিজেও তারাবীহর নামাজ পড়েছেন। হযরত উরওয়াহ ইবনে যুবায়ের (রা.) হযরত আয়েশা (রা.) হতে একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, একবার রাসূল (সা.) রমযান মাসে রাতের বেলা মসজিদে নববীতে নামাজ (তারাবী) আদায় করলেন। উপস্থিত লোকজনও তাঁর সাথে নামাজ আদায় করলেন। দ্বিতীয় দিনও করলেন এমনকি লোকসংখ্যা অনেক বেশি হলো। তৃতীয় এবং চতুর্থ দিনেও মানুষ একত্রিত হলো কিন্তু রাসূল (সা.) হুজরা থেকে বেরিয়ে তাদের নিকট এলেন না।
অতঃপর সকাল হলে আসলেন এবং বললেন, তোমাদের অপেক্ষা করার বিষয়টি আমি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এ ভয়ে আসা থেকে বিরত থেকেছি আমার আশঙ্কা হচ্ছিল না জানি উহা তোমাদের উপর ফরয করে দেয়া হয়। (বুখারী ৯২৪,মুসলিম ৭৬১ নং হাদীস)। সুতরাং এ থেকে বুঝা গেল, রাসূল (সা) নিজেও তারবীহর নামাজ পড়েছেন। পরবর্তীতে উনার আমলে এবং আবু বকর (রা) এর শাসনামলে মুসলমানরা একাকি বা খন্ডভাবে জামাতে তারাবী আদায় করতেন।
অবশেষে হযরত ওমর (রা.) হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) কে ইমাম নির্ধারণ করে সম্মিলিতভাবে জামা’আতের সঙ্গে ২০ রাকা’আত তারাবীহর নামাজ আদায়ে স্থায়ী ব্যবস্থা করেন। (বুখারী, ২০১০ নং হাদীস)। এক হাদীসে রাসূল সা বলেন, তোমরা আমার সুন্নাত এবং সঠিক পথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে দৃঢ়তার সাথে আটকে ধরো। (আবু দাউদ ৪৬০৭, তিরমিযী ২৬৭৬ নং হাদীস)।
আমরা সকলেই জানি, সাহাবীদের প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। কুরআন ও হাদীসে তাঁদেরকে বিশেষভাবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন তারকা সমতুল্য, তাঁরা যে বিষয়গুলো দেখেছেন, বুঝেছেন এবং পালন করেছেন তা আমরা তথা উম্মতের জন্যও জানা, বুঝা এবং মানা আবশ্যক।
রাসূল সা. অন্যত্র বলেছেন, যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখবে এবং তারাবীহর নামাজ আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে সেদিনের মতো নিষ্পাপ হবে যেদিন মা তাকে জন্ম দান করেছিলেন। (নাসায়ী শরিফ -২২২২ নং হাদীস)। এ হাদীসে তারাবীহর নামাজের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং এক বিশেষ ফযিলতের কথাও বলা হয়েছে। হানাফী মাযহাবের কিতাব গুনয়াতুল মুস্তামলিত সহ তাহতাবী কিতাবে আছে, ‘তারাবীহর নামাজ সুন্নাত, এই নামাজ বর্জন ও ছেড়ে দেয়া জায়েজ নাই।’
(কামুসূল ফিকহ:২য় খন্ড ৪৪৮ পৃ.)।
বর্তমান সময়ে তারাবীহর নামাজে রাকা’আত সংখ্যা নিয়ে একটি দ্বন্দ্ব দেখা যায়, এটা মোটেও সমীচীন নয়। আমাদের উচিত হবে প্রথমত, ফরয বিধান যথাযথভাবে পালন করা। এর জন্য নিজেকে সোপর্দ করা তার পাশাপাশি অন্যান্য সুন্নাত ও নফলসমূহ আদায় করা এবং অন্যদেরকেও এ বিষয়গুলোতে যথাসাধ্য উৎসাহিত করা।
রাসূল (সা.) চার থেকে শুরু করে বিশ রাকা’আত পর্যন্ত ক্বিয়াম করেছেন। আবু হানিফা (র.) এর অনুসারীরা এখনো ২০ রাকা’আত তারাবীহ আদায় করেন। কেউ চাইলে ৮ বা ১২ রাকা'আত ও পড়তে পারেন। এখানে নামাজের পরিমাণ অপেক্ষা গুণগত মানটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ফযিলতপূর্ণ এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত করাটাই শ্রেয়। যদিও তারবীহর নামাজকে ফরয করা হয়নি হয়তো তা অনেকের জন্য কষ্টকর হবে, তদুপরি বরকত হাসিলের উদ্দেশ্য এ নামাজ পড়তে হবে। এতে করে রমযান ও কুরআনের হক আদায় হবে। এ নামাজ আদায়ে তাকওয়া বৃদ্ধি পাবে।আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাত লাভ হবে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল সা এ মাসে এতো বেশি পরিশ্রম(ইবাদত) করতেন যা তিনি অন্য মাসে করতেন না। (মুসলিম)
তাই,এ রাতগুলোতে অনেক বেশি যত্নবান হওয়া জরুরি। আল্লাহর কাছে বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তেগফার করা জরুরি। রমযানের দীর্ঘ একটি মাস নিজের কলবকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে বাকি এগারোটি মাস এই চর্চার বিকাশ লাভই হোক রমযানের রোযা ও তারাবীহর নামাজের মূল উদ্দেশ্য।
আল্লাহ সবাইকে সহীহ বুঝ দান করুক।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১০ ব্যাচ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ