০৫ মে ২০১৯, ২২:৩৭

কেন বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে নেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো?

সোহেল রানা  © ফাইল ফটো

এশিয়ার সেরা ৪১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও নাম নেই। যেখানে শ্রীলংকা ও নেপালের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অবস্থান করে নিয়েছে। আমরা দিন-রাত যে পাকিস্তানের নাম শুনলেই নাক ছিটকিনি দিয়ে উঠি সে পাকিস্তানেরও আছে ৯টি প্রতিষ্ঠান। এশিয়ার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় আছে ‘ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘ইউনিভার্সিটি অব কলম্বোর নাম। এগুলো যথাক্রমে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর কৃতিত্ব দেখা হয় মূলত মূলত পূর্বের আন্দোলন সংগ্রামের ভিত্তিতে। যদি বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং আন্দোলন-সংগ্রামের ভিত্তিতে দেয়া হতো তাহলে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বিশ্বসেরার তালিকায় থাকতো।

কথা হলো তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো কেন পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে স্থান পায় না? আমাদের দেশের সন্তানেরা কী অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী? নাকি শিক্ষকেরা কি বিশ্বমানের নয়?

না, আমাদের দেশের সন্তানেরা কম মেধাবী নয়। জামাল নজরুল, সত্যন্দ্র নাথের মত বিশ্বমানের শিক্ষক আমাদেরও ছিল। আব্দুল্লাহ আবু সাইদ, জাফর ইকবালদের মত এখনো অনেক জীবন্ত কিংবদন্তী শিক্ষক দেশের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে আমরা কোথায় পিছিয়ে আছি? হ্যাঁ, আমরা পিছিয়ে আছি গবেষণায়, চিন্তা-চেতনায়, সঠিক পরিকল্পনায়, শিক্ষাব্যবস্থায়।

দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আসলেই আমরা আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়টি নিয়ে আসি। বিষয়টা ভালো, কিন্তু আন্দোলন সংগ্রামই যদি সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হবার নিয়ামক হতো, তবে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ই হতো বিশ্বসেরা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং করা হয় গবেষণায়। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা কি কি উদ্ভাবন করলো, কি আবিষ্কার করলো ইত্যাদি নিয়ামক দিয়ে। দুঃখের বিষয় হলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসবের চর্চা আমাবস্যার চাঁদের মতই।


আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে ছাত্ররাজনীতির সুদৃঢ় ইতিহাস। কিন্তু দেখেন আমাদের দেশের যে নিকৃষ্ট রাজনীতি তাঁর পটপরিবর্তন কী আমাদের ছাত্ররাজনীতি পরিবর্তন করতে পেরেছে? না পারেনি, তবে এই রাজনীতির সফলতা আসলে কী?ছাত্ররাজনীতি না পারছে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে, না পারছে তাঁদের আদর্শ নেতা তৈরি করতে। বরং শিক্ষার্থীরা তাঁদের সোনালি সময়টা অবহেলা, অযত্নে নষ্ট করছে। পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত নিকৃষ্ট ছাত্ররাজনীতি আছে বলে ইতিহাসে জানা নেই। যে ছাত্রের গবেষণাগারে সবসময় পড়ে থাকার কথা, কিছু উদ্ভাবনের চিন্তায় ব্যাকুল থাকার কথা, তখন তাঁরা ক্ষমতাসীনদের খুঁটি হয়ে থাকে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বড় ভাই, অমুক ভাই-তমুক ভাইয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে পড়াশোনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত গবেষণায় নিজকে নিয়োজিত করতে হবে।

শুধু ছাত্ররাজনীতিই নয়, শিক্ষক রাজনীতিও দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস গুলো প্রতিযোগিতার শীর্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদ; যেমন উপাচার্য, ট্রেজারার,রেজিস্টার, প্রক্টর পদ গুলোতে দলীয় রাজনীতির আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে প্রকৃত মেধাবী, যোগ্য ব্যক্তি পদগুলোতে যেতে পারে না। ফলশ্রুতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সঠিক পরিকল্পনার অভাব দেখা দেয়।

আমাদের দেশে শিক্ষাখাতে যে বাজেট দেওয়া হয় তা আমাদের পাশ্ববর্তীদেশগুলোর তুলনায় নিতান্তই নগণ্য। যাইবা দেওয়া হয়, তাও দুর্নীতিগ্রস্থ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গিলে ফেলে। এখন আমাদের দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থখাত হচ্ছে শিক্ষাখাত। ফলে যে বাজেট দেওয়া হয় তার নগণ্য অংশই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়াও আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের অবিরাম সংগ্রাম করতে হয়। একবেলা খেয়ে, অন্যবেলা খাবারের টাকা সংগ্রহে নিজেদের চিন্তায় মশগুল থাকতে হয়। তাছাড়া গণরুমে থেকে, ছারপোকার কামড় খেয়েই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা বড় অংশ কেটে যায়। কী করে আমরা গবেষণা করবো? কিভাবে করবো নতুন কিছু উদ্ভাবন? আমরা তো মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুককেই সবচেয়ে বড় গবেষণাগার মনে করি।

খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা শিক্ষার্থীরা সকালে তাদের ক্লাস না থাকলে না খেয়েই ঘুমিয়ে থাকে। যার কয়েকটা কারণ থাকবে। এসব অধিকাংশ শিক্ষার্থী দিনে দুইবেলা দেশের প্রধান খাদ্য ভাত গ্রহণ করে থাকে, বাকি এক বেলা ঘুম। অন্তত যেসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা না থাকলে ঘুম খেয়ে কাটিয়ে দেয়, তাদের থেকে গবেষণার মতো বিষয়গুলো আসা করা বৃথা।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সরকার সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদেরকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। সবার একান্ত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাবে দেশ, জাতি হিসেবে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা না করে আদর্শ পাঠাগার, গবেষণাগার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়াতে হবে এবং তাঁর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

তবে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর নেয়া উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হবে। তিনি আগামী বাজেটে শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সরকার তার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। শিক্ষাখাতে ব্যাপক উন্নয়ন করতে হলে বাজেট বাড়ানোর বিকল্প নেই। তবে আরেকটা বিষয় হচ্ছে বাজেট বাড়ালেই হবে না, এর জন্য আলাদা মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। বাজেট অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কিনা, শিক্ষার্থী পর্যন্ত বাজেট পৌঁছেছে কিনা এসব বিষয় দেখা শুনার জন্য।

সব ধরণের দলীয় করনের বাতিলে করে নিরপেক্ষতা আর যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা। শুধু কেবলমাত্র আন্দোলন-সংগ্রাম নয়, বিশ্বসেরাদের তালিকায় আসতে হলে অবশ্যই একাডেমিকভাবেও আমাদের এগুতে হবে। শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি উৎসাহিত করার পাশাপাশি তাদের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাহলেই কেবল আশা করা যায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব আসরে স্থান করে নিতে বেশি সময় লাবে না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যৌথ আন্তুরিকতার ভিত্তিতেই এসব অর্জন সম্ভব।