পুরুষের প্রতি নারীর কেন এত ক্ষোভ?

প্রতীকী
প্রতীকী  © টিডিসি ফটো

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। প্রত্যেকটি মানুষের জীবন অত্যন্ত পবিত্র ও মর্যাদাকর। পশু-পাখি আর মানুষের মাঝে মূল পার্থক্য হল বিবেক। আসল কথা হচ্ছে, মানুষের বিবেক আছে আর পশু-পাখির বিবেক নেই। বিবেক নামের এ বস্তুটির অনেকটা পানির মতো। সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ বিবেকের কারণেই মানুষ, পশু নয়। এসব সমাজে বেশিরভাগ সময় নারীর মনোভাবটা পুরুষের প্রতি চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

অনেকটা পুরুষ শাসিত এ সমাজের একটি ব্যাধি গুলোর মধ্যে নারী নির্যাতন অন্যতম। সমাজ সভ্যতা যতো এগিয়ে যাচ্ছে, সামনে ততোই যেন এই প্রবণতা বেড়ে চলেছে। মানুষ যতোই সচেতন হচ্ছে, ততোই যেন নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞতাই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের উদাসীনতা।

দেখা যায়, সমাজের শিক্ষিত সচেতন ও প্রভাবশালী মানুষের দ্বারাই নারীর সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটছে। তার চিত্র সম্প্রতি আমরা দেখতে পেয়েছি। ফেনীর নুসরাত, সুবর্ণচরের চার সন্তানের জননী, কুমিল্লার তনু এবং নাম না জানা আরও অনেক মেয়ে আছেন যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে ধর্ষিত জীবন নিয়ে বেঁচে আছেন, আবার অনেকে এই দূষিত সমাজকে অভিশাপ দিয়ে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। আর এইসব নিন্দনীয় ঘটনার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম, পত্রিকায় নিউজ প্রকাশিত হয়। কিন্তু কতখানি ফলপ্রসূ হচ্ছে এসব আন্দোলন? প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রভাব প্রতিপত্তির মাধ্যমে অপরাধী তার অপরাধের শাস্তি থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। নারীর উপর পুরুষের অবিরাম ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে সাম্প্রতিককালে এই নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে।

দারিদ্র, বেকারত্ব ও অশিক্ষার কারণে পদে পদে নির্যাতিত হচ্ছে নারী। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পেরে অসংখ্য নারীর জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাকসহ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিদ্যমান আইনগুলোর অনেকাংশেই যথাযথ প্রয়োগ নেই। এইতো গতকাল নোয়াখালীতে এক সন্তানের জননীকে যৌতুকের জন্য নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া, এইসব আইন সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ সচেতনও নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পৃথিবীব্যাপী এসব সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতি বছর অসংখ্য নারীর মৃত্যু হচ্ছে। কারণ তারা মুখ ফুটে কথা বলতে পারে না, তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। নির্যাতিত হওয়ার পর তাদের থাকতে হয় চাপের মুখে।

একটা ঘটনা আছে, একদিন একবার আমাদের এক বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছে। সে তার চাপা আর্তনাদের ভাষা আমাদের জানাচ্ছিল। তাকে সরকার দলীয় এক কর্মী ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়। সেই ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তার উপর নেমে আসে অত্যাচারের ঝড়। তার যখন মেয়েটাকে নানা ভাবে কষ্ট দিয়ে ভালো কোন সুযোগ করতে পারেনি, তখন তাদের ঘর বাড়ীতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটায়।

নারীদের উপর সহিংসতার আরেকটি কারণ হল এদের উপর সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। নারী নিজ পরিবারেও নির্যাতিত হচ্ছে। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। অনেক সময় তারা পরিবার, সমাজ, তাদের সন্তান-সন্ততির কথা ভেবে সহ্য করছেন বাধ্য হয়েই।

বছরের পর বছর নারীর প্রতি নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে আন্দোলন বা দিবস পালন করেও কি নির্যাতন কমছে? হয়তো সঠিক কোন উত্তর মিলবে না। বাংলাদেশের একটি চিত্র তুলে ধরলে অনেকখানি পরিষ্কার হওয়া যাবে বিষয়টির ব্যাপারে। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের জরিপে বলা হয়েছে, নারীর উপর তার পুরুষ সঙ্গীর শারীরিক নির্যাতনের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে শতকরা ১৪ ভাগ মাতৃমৃত্যু ঘটছে গর্ভকালীন নির্যাতনের কারণে। শতকরা ৬১ জনের বেশি পুরুষ এখনও মনে করে স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করা বৈধ। এছাড়া, নারীর প্রতি শতকরা ৮০ ভাগ সহিংসতা ঘটে পরিবারের ভিতরে। অন্যদিকে দেশে সংঘটিত মোট খুনের ঘটনার ৫০ ভাগই হচ্ছে স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যার ঘটনা। আর এসব নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটে গ্রামাঞ্চল বা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শহরাঞ্চলেও শতকরা ৬০ ভাগ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। মৌখিক নিপীড়নের শিকার হন ৬৭ শতাংশ নারী। এছাড়া যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে বছরে গড়ে ছয়শটি।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নারী নির্যাতনের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। অবশ্য তখন মানুষের মধ্যে এতো সচেতনতা ছিল না। তখন নারী নির্যাতন যে একটা অপরাধ সেটা হয়তো অনেকে জানত না, অনুধাবন করতে পারতো না। এখন সময় পাল্টাচ্ছে। শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়েছে মানুষ। সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে সকল মাঝেই। কিন্তু নারী নির্যাতনের মতো একটি মারাত্মক স্পর্শকাতর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। নারী সহিংসতা রোধে আছে আইন, বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক সনদ ও চুক্তি। কিন্তু এগুলোর কোন বাস্তবায়ন নেই। এসব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষও সচেতন নয়। তাই হয়তো একজন নারী তার কাছের মানুষটিকেও নিরাপদ মনে করে না।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বছরের পর বছর ধরে শুধু আন্দোলন নয়, নারী সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিরোধ করতে পারবে। যার মাধ্যমে নারী পাবে সহিংসতার প্রতিকার, গড়ে উঠবে নারী সহিংসতা মুক্ত একটি সুন্দর সমাজ। আর এই সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও অবিচার নিরসনকল্পে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। এজন্য আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা উচিত। একই সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অধিকারের পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের সুরক্ষা প্রয়োজন। বিবেক গর্হিত পশুদের মতো করে নয়, যাতে করে সমাজে সৃষ্টি সেরা জীব হিসেবে বিবেকবান মানুষের পরিচয়টা বহন করা সম্ভব হয়। 

আবদুর রহমান
শিক্ষার্থী: নোয়াখালী সরকারি কলেজ
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ


সর্বশেষ সংবাদ