অমর্ত্য-নবনীতার সম্মানজনক বিচ্ছেদ, হুমায়ূন-গুলতেকিনের মধ্যে বিতর্ক কেন?
কোনো সম্পর্ক ভেঙে গেলে তা নিয়ে আমাদের সমাজ একরকম আদালত বসিয়ে দেয়। দু'পক্ষের কেউ রেহাই পায় না। অথচ Incompatibility of temperament দেখা দিলে যেকোনো নিখাদ সম্পর্কও ভেঙে যেতে পারে। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন ও কবি নবনীতা দেবসেন দীর্ঘকাল সংসার করেছেন। তাদের দুটি কন্যাও আছে। কিন্তু একসময় মনে হয়েছে তাদের আর একসঙ্গে থাকার প্রয়োজন নেই। তাই তারা আলাদা হয়ে গেছেন।
নবনীতা বিয়ের পর দুই সন্তান মানুষ করেছেন। সঙ্গে দ্বিতীয় মাস্টার্স, পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরেট। তাও কেমব্রিজ, হার্ভার্ড ও ইন্ডিয়ানার মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর লেখালেখি? তার মতো চমৎকার লেখক খুব কমই আছেন। কবিতা ও গদ্যে অতুলনীয়। অমর্ত্য সেন তার সম্পর্কে আত্মজীবনীতে লিখেছেন : “I learned many things from her, including the appreciation of poetry from an ‘internal’ perspective.”
অপরদিকে নবনীতাও অমর্ত্যকে তার জীবনের অন্যতম প্রিয় মানুষ হিসেবে দেখেছেন। বিচ্ছেদের পরও তাদের যোগাযোগ হতো। কেউ কাউকে নিয়ে কোনো বাজে মন্তব্য করেননি। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে। তাদের দুজনই নিজেদের ক্ষেত্রে সেরা। কাজপাগল। আর এজন্যই তাদের বাড়তি কিছুর দরকার পড়েনি। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূলধন সমান হলে যেকোনো সম্পর্ক ভাঙার পরও পারস্পরিক সম্প্রীতি ধরে রাখা সম্ভব।
হুমায়ূন আহমেদ ও গুলতেকিনের মধ্যে ব্যক্তিত্বের প্রবল সংঘাত ছিল। গুলতেকিনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূলধন হুমায়ূনের সমান না হওয়ায় তার মধ্যে একটা ইগো তৈরি হয়েছে। সেই ইগো থেকেই হুমায়ূনের কিছু সিদ্ধান্ত গুলতেকিন মানতে চাননি। কিছু সাক্ষাৎকার ও লেখায় তার প্রমাণ মেলে। কিন্তু লেখক কি কারও বেঁধে দেওয়া সংবিধানমতো চলতে পারেন? টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, জীবনানন্দ দাশ বউদের কথায় চললে তাদের সাহিত্যচর্চা গোল্লায় যেত। সুখী দাম্পত্য জীবন আর লেখকজীবন সম্পূর্ণ আলাদা। জয় গোস্বামী একটি উপন্যাস লিখেছেন ‘ভেঙে যাওয়ার পরে’ শিরোনামে। এ উপন্যাসে তিনি তার স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার বিবরণ তুলে ধরেছেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, “জীবনে প্রেম এসে গেলে আটকাবো কীভাবে? আমার স্ত্রী ও কন্যাকে তা জানিয়ে দিয়েছি।” আর সবকিছু তার স্ত্রী-কন্যা জানার পরও তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটেনি। এর কারণ, তাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা পোক্ত।
কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ তাদের মধ্যবিত্ত আকাঙ্ক্ষা থেকে এখনও বেরুতে পারেনি। আর তাই সাহিত্যের চেয়ে আমরা সাহিত্যিকদের জীবন ঘাঁটতে পছন্দ করি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম স্ত্রী রেবেকার সঙ্গে নিষ্ঠুরভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করে সোফিয়াকে বিয়ে করেন। তাই বলে আমরা তাকে পড়ব না? ঘৃণা করব? সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ সংসারকে কারাগার বলেছেন। যদিও তার কথায় আমি একমত নই। সংসার ঠিক রেখেও সাহিত্য করা যায়। সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, সৈয়দ হক তাই করেছেন। লেখা তাদের সংসারে কালবোশেখির ঝড় বয়ে আনেনি। হুমায়ূন তা পারেননি। পারেননি বললে কিছুটা ভুল হবে, ঠিকমতো পারেননি। নিজের সন্তানদের তিনি ভালোবাসতেন। কিন্তু লেখালেখি ও খ্যাতির মোহকে আরও বেশি গুরুত্ব দিতেন।
ব্যক্তি হুমায়ূনের ছিল খুবই বেহিসেবী স্বভাব। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলতেন। ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রে ফেরদৌসের সঙ্গে নায়ক ছিল মাহফুজ। কিন্তু জাহিদ হাসান হঠাৎ একটু তেল মারায় হুমায়ূন আহমেদ মাহফুজকে বাদ দিয়ে জাহিদকে নেন! এ নিয়ে মাহফুজ এতটাই রাগান্বিত হন যে, তিনি হুমায়ূনের সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দেন! অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ও একই কারণে হুমায়ূনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেন। এক নাটকে জয়ন্তকে কাস্ট করে হঠাৎ করেই আরেকজনকে নিয়ে নেন হুমায়ূন! যা জয়ন্ত মানতে পারেননি! পরে অবশ্য বুঝিয়ে-সুজিয়ে সব মিটমাট করেছেন হুমায়ূন নিজেই! হুমায়ূন তার ওপর মাতব্বরি মানতে পারতেন না। এজন্যই কেউ না কেউ তার কাছে আহত হয়েছেন। এটা তার রূঢ় ব্যক্তিত্বেরই প্রকাশ।
তবে বড় পুত্র নুহাশের নামে ‘নুহাশ পল্লী’, ‘নুহাশ চলচ্চিত্র’ নামকরণ, কিংবা ১৮ বছর পর্যন্ত নুহাশকে নিয়মিত সময় দেওয়া, শেষজীবনে কন্যাদের মিস করা ইত্যাদি থেকে বোঝা যায়, পিতা হিসেবে তিনি খানিকটা রহস্যময়!
হুমায়ূনকে আমাদের সিরিয়াস লেখকবর্গ পছন্দ করেন না। কিন্তু তার মতো জনপ্রিয় লেখকও আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে নেই। হুমায়ূন এতটাই প্রভাবশালী যে, তার ডিভোর্সের কাহিনিও টক অব দ্য টাউন হয়ে ওঠে মৃত্যুর এক যুগ পরও। হুমায়ূনকে কেউ তৈরি করেনি। বরং তিনিই তার গোটা পরিবারকে লেখক ও শিল্পী পরিবার হিসেবে গড়ে তুলেছেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, গুলতেকিন খান, মেহের আফরোজ শাওন, আহসান হাবীব, নুহাশ হুমায়ূন—সবাই যে এত চটকদার গদ্য লেখেন, তার মূলে আছেন হুমায়ূন!
সুতরাং নিন্দা যতই হোক, সত্যরে লও সহজে!
শারফিন শাহ: লেখক ও গবেষক