কক্সবাজার থেকে সুন্দরবন: অব্যবস্থাপনায় কি হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সম্ভাবনা?
রেস্তোরাঁয় বসা বিদেশি ওই নারী অনেকক্ষণ ধরে অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দেখছিলেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমরা তখন বসে ছিলাম নেপালের পোখরা লেকপাড়ের এক রেস্তোরাঁয়। খাবারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করার ফাঁকে টেবিল চাপড়ে, জোর গলায় কোরাস করে একটার পর একটা বাংলাদেশের গান গাইছি। আমরা মানে জনা দশেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
২০০৯ সালের ঘটনা। আসলেই অবাক হয়ে আমাদের গান শুনছিলেন ওই বিদেশিনী! অবাক হওয়ারই কথা। কারণ আমাদের কারোই গানের গলা ভালো নয়। শুধু মনের আনন্দে গাইছিলাম। ইউরোপীয় চেহারার ওই নারী সেই গান শুনছিলেন। নিজের খাওয়া শেষে বিল দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি নাটকীয় ভঙ্গিতে আমাদের কাছে এলেন। এরপর ইংরেজিতে যা বললেন তার অর্থ, “তোমরা কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”
আমরা কিছুটা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছি। তিনি আমাদের অবাক করে দিয়ে বললেন, “তোমরা খুব সুন্দর গান গাইছিলে। প্রাণবন্ত। রেস্তোরাঁয় খেতে বসে এতটা জড়তাহীনভাবে কাউকে গান করতে আমি আগে দেখিনি। তোমাদের গানের ভাষাটাও মিষ্টি। কোন ভাষা? তোমরা কি ইন্ডিয়ান?”
শুনে রাগ হলো। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলাম, “না, আমরা বাংলাদেশি।” এবার তার পাল্টা প্রশ্ন, “বাংলাদেশটা কোথায়?”
বোঝা গেল তিনি বাংলাদেশের নাম শোনেননি। এবার তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার দেশ কোনটা? তুমি বাংলাদেশকে চেনো না?” তার জবাব, ফ্রান্সে। তিনি আসলেই বাংলাদেশকে চেনেন না। তবে ইন্ডিয়া চেনেন। সেখান থেকেই নেপালে বেড়াতে এসেছেন। গত কয়েক বছর ধরে তিনি ভারত ও নেপালে বেড়াচ্ছেন। তবে বাংলাদেশে কখনও যাননি।
কোনো বিদেশি পর্যটক যখন বলে বাংলাদেশ চেনে না, আমি তখন পর্যটন দিয়েই বাংলাদেশ চেনানোর চেষ্টা করি। সেবারও তাই। তাকে বললাম, “তুমি তো অনেক দেশ ঘোরো? সমুদ্র-সাগর-সৈকত এগুলো তোমার খুব পছন্দ, তাই না?” সে বলল, “হ্যাঁ।” আমার প্রশ্ন, “তাহলে বলো তো ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত কোথায়?” কিছুক্ষণ ভেবে তিনি বললেন, “জানা নেই।”
আমি তাকে বললাম, “বাংলাদেশের কক্সবাজারে টানা ১২০ কিলোমিটারের প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত। তোমরা যে ব্যাংকক, বালি বা ইউরোপে কয়েক কিলোমিটার সৈকত দেখে খুশি হও, কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার সৈকত দেখে কী বলবে? একজীবনে তো হেঁটেই শেষ করতে পারবে না।”
ফরাসি ওই নারী অবাক হয়ে আমার কথা শুনছিলেন। আমি বলেই চলেছি, সেন্টমার্টিন নামে একটা প্রবাল দ্বীপ আছে বাংলাদেশে। যেখানে গেলে মনে হবে এটা প্রকৃতির স্বর্গ। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নাম শুনেছ? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন কোথায় জানো? সেই সুন্দরবনও বাংলাদেশে। পাহাড় দেখতে চাও? সারি সারি মেঘ? চা বাগান? শত শত নদী? কত খরচ পড়বে এগুলো দেখতে জানো? ১০ থেকে ২০ ডলারে তুমি থাকতে পারবে। এক থেকে দুই ডলারে আরাম করে লাঞ্চ-ডিনার করতে পারবে।
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন তিনি। আমি তাকে বললাম, “তোমার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তাই না? আচ্ছা তুমি ইন্টারনেটে সার্চ দাও। ভারতে তুমি ঘুরতে যাচ্ছ, সেই ভারত আমাদের বাংলাদেশের সঙ্গেই ছিল। আমরা বাঙালিরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত থেকে আমাদের আলাদা করে দেয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা ভাষার জন্য লড়াই করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।”
কথা শেষে তিনি বললেন, আগামী বছরই বাংলাদেশ যাব। এরপর তিনি আমাদের সঙ্গে ছবি তুললেন তার ক্যামেরায়।
১৬ বছর আগের গল্পটা আজ আবার বলছি কারণ, আজ বিশ্ব পর্যটন দিবস।
এই পৃথিবীর প্রায় অর্ধশত ত্রিশেক দেশ আর কয়েকশ শহর দেখে আমার মনে হয়েছে, প্রকৃতি দুহাত ভরে বাংলাদেশকে দিয়েছে। এত নদী, পাহাড়, সাগর, সবুজ—সব মিলিয়ে এই দেশের পর্যটন প্রকৃতি অসাধারণ। কিন্তু সমস্যা আমাদের ব্যবস্থাপনায়। সারা দুনিয়াকে আমরা আমাদের প্রকৃতির কথা জানাতে পারিনি, ব্যবস্থাপনা ভালো করতে পারিনি।
এই যে পৃথিবীর ৭০টা দেশের নাগরিকের বাংলাদেশে আসতে ভিসা লাগে না, সেটাও আমরা তাদের জানাতে পারিনি। অথচ ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, নেপাল, জাপানে প্রতি বছর লাখো মানুষ বেড়াতে যান। কারণ তারা তাদের পর্যটনের প্রচার করতে পেরেছে। কিন্তু আমরা বিউটিফুল বাংলাদেশ নামে এত সুন্দর একটা বিজ্ঞাপন বানিয়েও পৃথিবীর কোনো দেশের টিভিতে দেখাতে পারলাম না। পৃথিবীকে জানাতে পারলাম না, বাংলাদেশটা খুব সুন্দর। ফলে বিদেশিরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত-নেপাল ঘুরে চলে যায়, বাংলাদেশে আসে না।
প্রকৃতি উদারভাবে দেওয়ার পরেও তা কাজে লাগাতে পারছি না। বছর দশেক আগে দুবাই ঘুরতে গিয়ে দেখেছি, মরুর শহর দুবাইতে ওরা সাগর সৈকতটা রক্ষা করে কাঠ দিয়ে দারুণ করে সাজিয়ে রেস্তোরাঁ বানাচ্ছে মাইলের পর মাইল। সৈকতের কাছে কোনো বড় স্থাপনা নেই। এখানে চাইলে নিরিবিলি হাঁটতে পারবেন যে কেউ। যে কোনো দোকানে ঢুকে ইচ্ছামতো সব খেতে পারবেন। আর আমরা কক্সবাজারটাকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছি। আমরা পারলে সৈকতের মধ্যেও ভবন তুলে হোটেল বানাই।
আসলে আমরা জানি না কীভাবে নিজের দেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হয়। আর আমাদের কোনো সত্যিকারের পরিকল্পনাও নেই। আচ্ছা বিদেশিরা কক্সবাজারে কী জন্য যাবে? আমাদের কী বিনোদনের সব ব্যবস্থা আছে? মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাতে সব থাকলেও সমস্যা হয় না। এমনকি সৌদি আরবও যেখানে তাদের দরজা উন্মুক্ত করছে বিদেশিদের জন্য, সেখানে আমরা এখনও বসে আছি মান্ধাতার আমলে। আমার মনে হয় শুধুমাত্র ব্যবস্থাগত ত্রুটির কারণে আমরা আমাদের পর্যটনকে বিপণন করতে পারলাম না।
বিদেশির কথা বাদ দিলাম, দেশের মানুষের শান্তিতে ঘোরার জন্য আমরা কতটা করতে পারছি? সিলেটের রাতারগুল বা অন্য কোথাও বেড়াতে যাবেন? রাস্তাঘাট ভালো না। কক্সবাজারে যাবেন? দেখবেন শহরজুড়ে আবর্জনা, নোংরা, অব্যবস্থাপনা আর গলাকাটা দাম তো আছেই। নেই শুধু সত্যিকারের সেবা।
অবশ্য এত সংকটের মধ্যেও আমাদের তরুণরা বেড়ানোর নতুন নতুন জায়গা বের করছে। আরেকদল ইকো ট্যুরিজম করছে। কিন্তু অবকাঠামোগত নানা সমস্যা আর দুর্ভোগ, সেই সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে মব উত্তেজনা, আগুন। সচ্ছল যাদের তারা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। অথচ একটু আরামদায়ক, স্বস্তির পরিবেশ থাকলেই কিন্তু মানুষ দেশেই বেড়াতে বের হতে পারত।
ঢাকা শহরের কথাই যদি ধরি, এই শহরের মানুষ যদি ছুটির দিনে ঘুরতে চায় তাহলে কোথায় যাবে? কোনো জায়গাই কিন্তু নেই। অথচ ঢাকার চারপাশে নদী ছিল। ব্যাংকক শহরের নদী চাওফ্রেয়ায় সারাদিন নানা প্যাকেজে মানুষ ঘুরে বেড়ায়। গান হয়, নানা অনুষ্ঠান হয়। আর আমাদের বুড়িগঙ্গা-তুরাগ তো রক্ষাই করতে পারছি না!
শুধু বুড়িগঙ্গা-তুরাগ কেন? এ দেশে শত শত নদী। আমরা চাইলে নদীর তীরে সুন্দর করে সাজাতে পারতাম। নিয়মিত নদীতে ভ্রমণ প্যাকেজ থাকতে পারত। নৌপথে সারাদেশে ঘোরা কিংবা গভীর সাগরে ৭ দিন থাকার নানা ধরনের আয়োজন থাকতে পারত। আরও কত কী সম্ভব! কিন্তু প্রস্তুতি নেই।
বাংলাদেশের পর্যটনকে এগিয়ে নিতে ১৯৯২ সালে একটা জাতীয় পর্যটন নীতিমালা হয়েছিল। ওই নীতিমালায় যা ছিল আমরা তার কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারিনি। পরে ২০১০ সালে নতুন নীতিমালা হলো। আগের নীতিমালার সব এখানে আবার আনা হলো। ভালো ভালো সব কথা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই।
এ ছাড়া দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে ২০২০ সালে মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু হয়। সেটিও পরে আর বাস্তবায়ন হয়নি। অনেকেই বলেন, পর্যটন শিল্প কাজে লাগাতে পারলে দেশের জিডিপির অন্তত ১০ শতাংশ আসবে এই খাত থেকে। সেজন্য বাংলাদেশের কোনো প্রস্তুতি আছে কি?
আজকে বিশ্ব পর্যটন দিবসে কথাগুলো লিখছি। বছরের পর বছর ধরে এই কথাগুলো লিখেছি। সত্যি কথা বলতে গেলে, বাংলাদেশটা ভীষণ সুন্দর। আমাদের সম্ভাবনা বিশাল। কিন্তু প্রস্তুতি সামান্য। ব্যবস্থাপনা নেই বললেই চলে। আর এই দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, চাঁদাবাজি, হয়রানিসহ নানা সমস্যা তো আছেই। এত কিছুর পরেও বিশ্বাস করি, আমরা যদি নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা ঠিক করে সারা দুনিয়াকে বলি, হে বিশ্ববাসী! আসো। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতের দেশে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সুন্দরবনে, শত শত নদীর দেশে। ঘুরে যাও সবচেয়ে কম খরচে। মানুষ আসবেই।
আফসোস আমরা আমাদের দেশটাকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে পারিনি। দেশ নিয়ে আমরা দূরদর্শী পরিকল্পনা করতে পারিনি। তারপরও বছরের পর বছর ধরে এই কথাগুলো লিখি—যদি কখনো আমাদের বোধ ফেরে! ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ! সবাইকে বিশ্ব পর্যটন দিবসের শুভেচ্ছা। ভ্রমণ হোক জীবন!
শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, বিশ্লেষক