স্মৃতির পাতায় কোম্পানীগঞ্জ স্টুডেন্টস ফোরামের নীলাচল ভ্রমণ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ স্টুডেন্টস ফোরামের আনন্দ ভ্রমণের তারিখ ঘোষণা করা হয় ২০ এপ্রিল। পালাক্রমে আমরা সবাই ভ্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকি। সবাই সবার ব্যস্ততা ভুলে গিয়ে ভ্রমণের পরিকল্পনা শুরু করে। ফোরামের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ইমার ভাইসহ ফোরামের দায়িত্বশীলদের প্রচেষ্টায় অবশেষে কাঙ্ক্ষিত মূহুর্ত আসে ২০ এপ্রিল শনিবার।
আমরা অনেকেই শহরে ছিলাম। আবার অনেকে ক্যাম্পাসে। ভ্রমণের নির্ধারীত বাস সকাল ৬টায় ক্যাম্পাসে চলে আসে। সেখান থেকে দুপুরের খাবার সামগ্রী এবং ক্যাম্পাসে যারা থাকে তাদের নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় বাস। আমরা যারা শহরে থাকি, আমরাও সকাল ৭টার মধ্যে শহরের চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সের সামনে এসে জড়ো হই। সবাই একে অপরের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করছিলাম। সাড়ে সাতটার দিকে আমাদের নির্দিষ্ট বাস এসে হাজির হয়। আমরা একে একে সবাই বাসে উঠে পড়ি। সবাই সবার পরিচিত কিংবা বন্ধু বান্ধবের পাশের সীটকেই বসার জন্য বেছে নিয়েছে।
ততক্ষণে বাস চলতে শুরু করে। এরপর ফোরামের সভাপতি মুজাহিদ ভাই মাইক্রোফোনটি হাতে নিয়ে সবাইকে আনন্দ ভ্রমণে স্বাগত জানিয়ে কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে ভ্রমণের কার্যক্রম শুরু করলেন। এরপর তাজুল ইসলাম হাকিম ভাই একটি গজল পরিবেশন করলেন। তারপর অন্য কার্যক্রম শুরু করার পূর্বেই ফোরামের সদস্যরা সবার মাঝে সকালের নাস্তা বিতরণ করলেন। এরপর থেকে পালাক্রমে কেউ গান গাইছে, কেউ কবিতা আবৃত্তি আবার কেউ কৌতুকের মধ্য দিয়ে সকলকে মাতিয়ে রাখে।
এদিকে ভ্রমণের মূল আকর্শন র্যাফেল ড্রয়ের জন্য টিকেট বিক্রি করতে শুরু করলেন সদস্যরা। কেউ পাঁচটা কেউ সাতটা এভাবে সবাই সবার সাধ্যের মধ্যে টিকেট সংগ্রহ করলো। একপর্যায়ে আমরা আমাদের প্রথম স্পটে চলে আসি। সেটা ছিলো বন প্রপাত। সেখানে অনেক বড় একটা ঝর্ণা দেখেছিলাম আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঝর্ণায় কোনো পানি ছিলো না। তাই সেই স্পটে শুধু ছবি তোলা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না। আমরাও তাই করলাম। সবাই মিলে গ্রুপ ছবি নিলাম। কেউ কেউ সেলফি নিচ্ছিলো। সেখানে আর সময় নষ্ট না করে পরের স্পট স্বর্ণ মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম আমরা। বেলা সাড়ে ১১টায় সেখানে পৌঁছে ভিতরে ঢোকার জন্য টিকেট সংগ্রহ করি আমরা। প্রখর রোদের মধ্যেও আমরা মন্দির ঘুরে দেখি। যদিও টাইলস গুলো এতটাই তপ্ত ছিলো যে, কোথাও দুই তিন সেকেন্ডের বেশি দাঁড়ানো যাচ্ছিলো না। তারপরও আমরা সবাই মিলে ধৈর্য্য ধরে দুএকটা গ্রুপ ছবি নিলাম। এরপর সবাই ছায়ায় সরে আসলো। কিন্তু কেউ কেউ তখনো ছবি তুলছিলো। আমরা তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এটাও কি সম্ভব?
যাইহোক প্রায় ঘন্টাখানেক সেখানে ছিলাম আমরা। তারপর পরের স্পট মেঘলার উদ্দেশ্যে আমাদের রওয়ানা। সেখানে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তবে পাহাড়ের বুকে আঁকাবাঁকা রাস্তা গুলো ছিলো অসাধারণ। পাশাপাশি চালকের ড্রাইভিং দক্ষতা দেখেও মুগ্ধ হয়েছিলাম। কারণ, অমন ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তার মোড়গুলো যেভাবে দক্ষতার সাথে তিনি ড্রাইভিং করছিলেন। সেটা সত্যিই প্রশংসনীয়। তারপর দুপুর একটায় আমরা মেঘলায় এসে পৌঁছাই। সেখানে একটা যাত্রী ছাউনির নিচে সবাই মিলে বসে খাওয়া দাওয়া করলাম। তারপর মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রের টিকেট কেটে সবাই ঢুকে পড়লাম। কেউ কেউ জোহরের নামাজ পড়ে নিলো। বাকিরা পাহাড়ে উঁচু নিচু পথ ধরে নিচে নামতে লাগলো। ঝুলন্ত ব্রিজগুলোতে দোল খেতে খেতে ছবি তুলছিলো অনেকে। গ্রুপ ছবি তো ছিলোই। এরপর আমরা কয়েকজন ক্যাবল কার এ উঠলাম। ক্যাবল কার যখন লেকের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। তখন কেউ ভিডিও করছিলো, আবার কেউ সেলফি নিচ্ছিলো। দু-এক মিনিটের ক্যাবল কারের ভ্রমণও ছিলো অসাধারণ অনুভূতি। তারপর সেখানে আমাদের একটা প্রতিযোগিতার ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হলো। সেটা ছিলো 'উড়ে এমন বস্তুর নাম নিলে প্রতিযোগিরা হাত নাড়াতে হবে। আর অন্য যেকোনো বস্তুর নাম নিলেই হাত নামাতে হবে। কেউ যদি ভুল করে সে বাদ পড়ে যাবে। সেখানে জহির ফয়সাল ভাই, আমি এবং ইয়াসিন ভাই বিজয়ী হই। তারপর সেখানে বেশকিছু গ্রুপ ছবি তুলে মেঘলা পর্ব শেষ করে সর্বশেষ স্পট নীলাচলের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি আমরা। ততক্ষণে চাঁদের গাড়ি খ্যাত সেখানকার লেগুনা গুলো এসে হাজির হয়। আমরা কয়েক বোতল পানি নিয়ে চাঁদের গাড়িতে করে উঁচু পাহাড়ের পথে রওয়ানা হই। সবাই তখন সমস্বরে গান ধরেছিল। পাশাপাশি পাহাড়ের চুড়া থেকে নিচের বান্দরবান শহরটাকে দেখছিলো। এভাবে কিছুক্ষণ পর আমরা নীলাচলে পৌঁছে যাই।
সেখানেও বরাবরের মত টিকেট কেটে সবাই প্রবেশ করি। বিকেলের একটু রোদ ছিলো। কিন্তু রোদের তেমন তেজ ছিলো না। তাই বেশ ভালোই লাগছিলো সবার কাছে। তারপর সবাই সবার মত করে বিভিন্ন স্পটে ছবি তুলতে লাগলো। কেউ কেউ হাজার মিটার উপর থেকে নিচের ছোট ছোট ঘর বাড়িগুলো দেখছিলো। এরমধ্যে চুয়েটের জাবের হোসেন রিয়াব ভাইয়ের গিটারে আর গানের সাথে সবাই তাল মিলিয়ে গাইতে শুরু করলো জনপ্রিয় সব বাংলা গান। কখনো বাউলগান ‘মিলন হবে কত দিনে’ কখনো অনুপম রয়ের ‘আমাকে আমার মত থাকতে দাও’ এমন নানান গানে মাতিয়ে রেখেছিলো নীলাচল পার্ক। একপর্যায়ে আমাদের প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয় নীলাচল পার্কেই। সেটা হলো একটা ঝুঁড়িতে বল নিক্ষেপ করতে হবে। যারা ঝুঁড়িতে বল ফেলতে পারবে না। তারা বাদ পড়বে। সেটা ছিলো সবচেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতা। সেখানে প্রথম স্থান অর্জন করেন জহিরুল ইসলাম জুয়েল ভাই, এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করেন যথাক্রমে সাব্বির ভাই ও সৌরভ ভাই। এরপর মেয়েদের জন্য ছিলো মিউজিক্যাল পিলো। সেখানে প্রথম স্থান অর্জন করেন তাসলিমা আক্তার পপি।
এদিকে যারা নীলাচলে আগেও এসেছিল তারা ছবি তেমন একটা না তুললেও যারা প্রথমবার এসেছে তারা মেমোরি ভর্তি ছবি তুলে নিচ্ছিলো। সেখানে আমরা বেশকিছু গ্রুপ ছবিও তুলেছি। আর সব ছবিগুলোর পিছনে ছিলেন ফটোগ্রাফার শাফায়াত ইসলাম ও শিহাব ভাই। সারাদিন আমাদের সব ছবি উনারাই তুলেছেন। যদিও তারা এসেছিলেন গেস্ট হিসেবে। বুড়িচং এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শামসুল ইসলাম সৌরভ ভাইয়ের বন্ধু তাঁরা।
এদিন ফোরামের প্রাক্তন সভাপতি জহিরুল ইসলাম জুয়েল উপস্থিত ছিলেন। বেশ ভালো গাইতেও পারেন তিনি। কবিতা আবৃত্তি, কোরআন তেলাওয়াত দুটোই ছিলো মুগ্ধ করার মত। আমরা পথিমধ্যে যে নামাজগুলো পড়েছি। সবগুলোতে উনিই ইমাম ছিলেন। এছাড়া প্রাক্তন সদস্যদের মধ্যে সাবেক সাধারণ সম্পাদক দাউদ নবী রাসেল ও সাংগঠনিক সম্পাদক আলী হোসেন রিংকু উপস্থিত ছিলেন।
তারপর সন্ধ্যায় আমরা পুনরায় রওয়ানা দেয়ার পূর্বে নীলাচল পার্কের সামনে বেশ কয়েকটি গ্রুপ ছবি তুলি। এরপর আবার চাঁদের গাড়িতে উঠে রওয়ানা হই মেঘলার উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে বাসে উঠি। বিকেলের নাস্তা শেষে র্যাফেল ড্রয়ের পর্ব শুরু হয়। ততক্ষণে বাস আবার চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। একে একে র্যাফেল ড্রয়ের দশজন বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়। র্যাফেল ড্রয়ের পুরস্কারের পাশাপাশি ফোরামের প্রাক্তন সদস্যদের হাত থেকে বিভিন্ন ইভেন্টের বিজয়ীরা পুরস্কার গ্রহণ করে। কেউ কেউ একাধিক পুরস্কার পেয়ে মহা খুশি। আবার কেউ কোনো পুরস্কার না পেয়ে সাময়িক মন খারাপ করেছিল। এরপর সবাই যার যার আসনে বসে পড়লো। বাসের লাইটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো। সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে চোখ বন্ধ করেছে। কেউ মাইক্রোফোন হাতে গজল / গান শোনাচ্ছিলো।
এরমধ্যে হাফসা ফারজানা আপু খুব সুন্দর একটি গজল পরিবেশন করলেন। সবাই করতালিতে আপুকে স্বাগত জানালেন। এভাবে এক পর্যায়ে আমরা চট্টগ্রাম শহরের কাছাকাছি চলে আসলাম। কিন্তু এর আগেই সবাই কর্ণফুলী নদীর ব্রিজে বাস থামাতে বললেন। দশ মিনিটের জন্য নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বিশুদ্ধ বাতাসে নিজেদের সারাদিনের সব ক্লান্তিকে দূর করে নিলো সবাই। তারপর আবার বাসে করে রওয়ানা হলাম। শহরের মুরাদপুর, দুই নাম্বার গেটসহ বিভিন্ন স্পটে অনেকেই নেমে গেলো। তারপর রাত ১১ টায় বাস বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌছাল। সবাই সবার মত বাসায় ফিরেছে। শুধু স্মৃতির পাতায় লিখে গিয়েছে আরও একটি আনন্দ ভ্রমণের গল্প।