বিচারহীনতার সংস্কৃতিই নুসরাতদের মৃত্যুর জন্য দায়ী!
- ফারুক হাসান
- প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:৪৭ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:০২ AM
রাষ্ট্রের অন্যতম একটি স্তম্ভ হচ্ছে বিচার বিভাগ। দীর্ঘদিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলতে থাকলে মানুষের আর ন্যায় বিচারের প্রতি আস্থা থাকে না। মানুষের আস্থার শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে বিচার বিভাগ। মানুষ যখন আইন বিভাগ থেকে ন্যয্য অধিকার পায় না, যখন শাসন বিভাগের দ্বারা ন্যয্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় তখনই মানুষ শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগের দারস্থ হয়। কিন্তু মানুষ যখন বিচার বিভাগের কাছ থেকেও আশানুরূপ ফল পায় না তখনই একটি অপসংস্কৃতির সৃষ্টি হয় যার নাম ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’।
আমরা দেখছি বাংলাদেশে অসংখ্য ঘটনা নিয়মিত ঘটে যাচ্ছে। ঘটনা ঘটার পর তরিত গতিতে প্রশাসন কিংবা দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে কয়েক সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করে দেওয়া হয়। এই কমিটি গঠন করার উদ্দেশ্য যে ঘটনার গতি প্রকৃতির গতিপথকে মন্থর করানোর জন্য তা আমরা অবুঝ বাঙালি বুঝি না। আজ অবধি দেশে হাজারো ঘটনা ঘটেছে বা ঘটতেছে এবং তার তদন্ত কমিটিও হয়েছে বা হচ্ছে, কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আজ পর্যন্ত কয়টা কমিটি তদন্ত রিপোর্ট সঠিকভাবে দিয়েছে...? দুই একটা কমিটি যদিও ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে তদন্ত রিপোর্ট সঠিকভাবে দিলেও তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা কতোটা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুজতে গেলে ফলাফলের খাতায় শূন্য ছাড়া বেশি কিছু জুটবে না। তাইতো কবি এসব প্রশ্নের জবাবে নিরব ভূমিকা পালন করে।
গত পরশু ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এই ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রিন্ট ইলেকট্রনিকস মিডিয়া সবাই সরগরম। আমরাও মানববন্ধন বিক্ষোভের মাধ্যমে রাজপথ গরম রেখেছি। সরকারও কোন অংশে কম নয়, উনারাও আমাদের সাথে তাল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।
ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নিতে অপরদিকে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন যারা দোষী তাদের কোন ছাড় নয়। আমি বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে এই জন্য সাধুবাদ জানাই, অন্তত এই ঘটনায় উনারা দ্রুত সাড়া দিয়েছেন। যদিও অতীত ইতিহাস ঘাটলে আমরা হতাশই হবো। কারণ এর আগে এরকম ঘটনাগুলোতে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা উত্তরের মুখোমুখি খুবই কম হয়েছেন। আমি এখানে প্রশ্নের মুখোমুখি বলছি না কারণ তিনারা প্রশ্ন খুবই কম করেন কিন্তু মিডিয়া যা প্রশ্ন করে তার উত্তর ৩৬০° কোণে দিয়ে দ্রুত মিডিয়ার সম্মুখভাগ ত্যাগ করেন।
এখন আসি আসল কথায়! আজকে নুসরাতদের কেন এভাবে জীবন দিতে হলো। তার তো আজ পরীক্ষার হলে থাকার কথা কিন্তু সে আজ সাড়ে তিন হাত অন্ধকার একটি প্রকোষ্ঠে দুনিয়ার আলো বাতাস থেকে অনেক দূরে। নুসরাতেকে এই অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য যারা দায়ি তারা যথাযথ শাস্তি পাবে কি না সন্দেহ রয়ে গেছে। তবে ইতোমধ্যে কয়েকজন মূল হোতাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করেছেন এই জন্য তাঁরাও ধন্যবাদ পাওয়ার প্রাপ্য আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই।
কিন্তু অতীত ইতিহাসের দিকে গেলে আমরা শুধু হতাশই নয় ব্যথিতও হই। যখনই সাগর-রুনীর কথা মনে করি তখন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিন্তা করি ছোট্ট বাচ্চাটার জন্য, যে তার জন্মের পর পিতা মাতার স্নেহের স্বাদ থেকে বঞ্চিত আর আমি মনের গহীনে মন রেখে ভাবি সে কি তার পিতা-মাতার হত্যার সঠিক বিচার আদৌও পাবে।
যখনই নারায়ণগঞ্জের তকীর কথা মনে পড়ে, তখনই বুকটা হুহু করে কেঁপে ওঠে। তকী হত্যার ফাইল এই টেবিল থেকে সেই টেবিল ঘুরতে ঘুরতে ফাইলের কাগজ ছিড়ে যায় কিন্তু মামলার সুরাহা হওয়ার কোন খবর নাই।
আমরা যখন অভিজিৎয়ের দিকে তাকাই তখন তার রক্ত মাখা মুখখানা দেখে আমাদের জবান বন্ধ হয়ে যায়। আমি কিছু লেখতে চাইলেও লেখতে পারি না তাকে নিয়ে। সর্বশেষ আলোড়ন সৃষ্টিকারী কুমিল্লার মেয়ে তনু হত্যার বিচার, আমরা কি আজো এই তনু হত্যার বিচার পেয়েছি..?
উত্তর আসবে না। জানতে চাইলে উত্তরদাতারা বলবেন কাজ চলমান আর চলমান কোন বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি নয়। এতেই উনাদের দায়িত্ব শেষ।
এই তনু, তকী, অভিজিৎ, সাগর-রুনীদের মতো অসংখ্য ঘটনা আমাদের সমাজে নিয়মিত ঘটে যাচ্ছে কিন্তু আমরা সবকিছু জানতে পারি না, যা কিছু জানতে পারি তা মিডিয়ার কল্যানে। আজ যদি
এই ঘটনা গুলোর সুষ্ঠু বিচার আমরা দেখতে পেতাম তাহলে হইতো নুসরাতদের এভাবে আর জীবন দিতে হতো না।এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই নুসরাতদের মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে দায়ী।
ইতোমধ্যে মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন, নুসরাতের মামলার বিচারকার্যে গাফলতি পেলে তদন্তকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় নিম্ন আদালতে স্পর্শকাতর মামলার তদন্তে অনেক গাফলতি হয়। তা না হলে কেন মহামান্য হাইকোর্ট এই নির্দেশ দিবেন।
আমি আশা করবো, সরকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নুসরাত হত্যায় জড়িতদের বিচারকার্য সঠিকভাবে করে ন্যায় বিচারের সংস্কৃতির একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির পরিবর্তে বিচারের সংস্কৃতি চালু হোক এটাই ২০১৯ সালের তরুণ প্রজন্মের প্রত্যয়!!
লেখক: যুগ্ম-আহবায়ক, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ