১২ এপ্রিল ২০১৯, ১২:২৫

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মান নতুন করে যাচাই করতে হবে

খ আলী আর রাজী  © ফাইল ফটো

আমার বিশ্বাস, আমাদের লোক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সকল ব্যর্থতা-দুর্বলতার আঁতুরঘর হচ্ছে এর শিক্ষককূল। লোক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের সার্বিক মান নিয়ে দেশের সব পর্যায়ের মানুষেরই নানান প্রশ্ন আছে। খোঁজ নিয়ে বুঝেছি, খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী তাদের বিরাট সংখ্যক শিক্ষকদের শিক্ষকতার মান নিয়ে তীব্রভাবে অসন্তুষ্ট। আর আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়াচ্ছেন, তাঁদের শতকরা অন্তত চল্লিশ ভাগ, শিক্ষক হিসেবে অতি-অযথার্থ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এঁদের পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষককূলকে বেতন-ভাতা-সুযোগ-সুবিধা যেটুকুই দেওয়া হচ্ছে তার প্রায় পুরোটাই জলে যাচ্ছে। এটা একটা দেহ থেকে অব্যহত রক্তক্ষরণের মতো। রাষ্ট্রের এই বিনিয়োগ কোনো ফল তো দেবেই না উলটো দেশটাকে, এর ভবিষ্যৎকে রক্তশূন্য করে ফেলছে। এটা আর একদিনও চলতে দেওয়া উচিত না।

নানান কারণে বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক হিসেবে আমরা নিয়োগ পেয়ে গেছি। নিয়োগ প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে ত্রুটিযুক্ত। বিভিন্ন সময় নিয়োগের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারা তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করাও এই ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরির একটা বড় কারণ হতে পারে। নিয়োগ প্রক্রিয়া ও নিযুক্তির শর্ত বদলে ফেলে নতুন নিয়োগের গুণমান বিপ্লবাত্মকভাবে বদলে ফেলা সম্ভব। কিন্তু যে বিপুল বোঝা এরই মধ্যে জনগণের ঘারে চেপে বসেছে, তার সুরাহা কী?

আমি নানান কিছু ভেবেছি, নানান দিক থেকে। একটা প্রস্তাব নিয়ে কাছের মানুষদের সাথে আলাপ করে মনে হয়েছে, এই প্রস্তাব আমাদের রাষ্ট্রজনদের ও কর্তাব্যক্তিদের জানানো উচিত। জনমত তৈরি করাও জরুরি।

প্রস্তাবটা হচ্ছে, আগামী দু'তিন বছরে প্রায় হাজার পাঁচেক শিক্ষককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মতো কোনো একটা প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় দেওয়া। এই সংখ্যা আমাদের লোক-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট শিক্ষকের ৪০ শতাংশের মতো। এতে দু-তিন বছরে যদি পাঁচ-ছয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ও হয়, রাষ্ট্র দীর্ঘমেয়াদী এই রক্তক্ষরণ থেকে বেঁচে যাবে। শিক্ষার্থীরা এই শূন্যগর্ভ শিক্ষকদের কবল থেকে দ্রুততম সময়ে রেহাই পেয়ে যাবে। এই বিপুল অযথার্থ শিক্ষককে অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার উপযুক্ত করার চেষ্টা যে দেশের বোঝা আরও বাড়াবে সে নিয়ে আমার কোনো সংশয় নাই।

কেন্দ্রীয়ভাবে একটি নির্দিষ্ট কমিশন/টাস্কফোর্স/ট্রাইবুন্যাল আগামী দু তিন বছর ধরে বেশ কয়েকটি মানদণ্ডের আলোকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের বাছাই করতে পারে। শিক্ষকদের অতীতের ফলাফল, ডিগ্রি বা পদ যাই হোক না কেন, তারা বাংলা-ইংরেজি ভাষা বোঝেন কি না, অন্তত বাংলায় শুদ্ধভাবে বক্তৃতা দিতে পারেন কি না, তারা বাংলায় লিখতে পারেন কি না, শিক্ষার্থীরা তাঁদের পড়ানোর মান সম্পর্কে কেমন রায় দেন -এ রকম কিছু অতিসাধারণ মানদণ্ড ব্যবহার করেই হাজার তিনেক শিক্ষককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেওয়ার জন্য বাছাই করা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রাথমিকভাবে যদি, এই ভাবনাটি আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক/কর্তাব্যক্তিদের মনে ধরে, তাহলে এই প্রস্তাবকে নিশ্চয়ই নিঃখুত করে তোলা যাবে।

এই বিদায় পর্বের পাশাপাশি চলবে নতুন শিক্ষক নিয়োগ। নতুন নিয়োগের জন্য কীভাবে অধিকতর কার্যকরী শিক্ষক খুঁজে পাওয়া সম্ভব এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করে নীতিমালা ঠিক করা যেতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে আমার প্রকল্পটি এমন-

কেন্দ্রীয়ভাবে একটি নির্দিষ্ট কমিশন/টাস্কফোর্স প্রতিদিন চালিয়ে যাবে নতুন শিক্ষক বাছাইয়ের কাজ। এক্ষেত্রে শিক্ষকতা করতে আগ্রহীদের ভাল ফলাফলের পাশাপাশি, যেসব দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাবের কারণে কর্মরত শিক্ষকদের বিদায় করার প্রস্তাব করা হয়েছে সেসব দক্ষতা-যোগ্যতা থাকতেই হবে। সাথে বাড়তি যোগ্যতা হবে বাঙলা ভাষায় দক্ষতা। বাঙলা ভাষাতে যদি কোনো বাঙলাদেশি শিক্ষক ভাল না হন তাহলে সেসব পদে বিদেশি উচ্চ ডিগ্রিধারী, ইংরেজি ভাল জানা শিক্ষক স্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। (বাংলা না জানলে বাংলাদেশি শিক্ষক দিয়ে এই রাষ্ট্র কী করবে? সেসব পদে অধিকতর যোগ্য বিদেশি নিয়োগ দেওয়া কল্যাণকর হবে।)

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান কারণে শিক্ষকতায় ঢুকতে পারেননি কিন্তু নিজস্ব প্রচেষ্টায় বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন, মাস্টার্স/পিএইচডি করেছেন আমাদের এমন সন্তানদের যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে, মেয়দি চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ দিলে ফল ভাল পাওয়া যাবে বলে অনুমান করি।

এই অন্তর্বতীকালীন জরুরি পদক্ষেপগুলো দু/তিন বছরে সমাধা করে এরপরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আবার নিজেদের মতো চলতে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এমন একটি ক্র‍্যাশ-প্রোগ্রাম নেওয়া ছাড়া এই দেশের জনগণ উচ্চ শিক্ষায় যে ব্যয় করছে তার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে না। যে কারণে বা যেভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই পর্যায়ে আসুক না কেন, একটা রাষ্ট্র এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি বহন করতে পারে না। এর থেকে আশু পরিত্রাণের জন্য পথ খুঁজে পেতেই হবে। আমাদের এ নিয়ে অনেক বেশি কথা বলতে হবে। আত্মসমালোচনা চালাতে হবে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্রুততর সময়ে, শিক্ষার-মান এবং প্রকৃত শিক্ষকদের মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য একটি ট্রাইবুন্যালের আওতায় কর্মরত শিক্ষকদের মান যাচাই ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে।

[লেখক: খ আলী আর রাজী, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]