প্রয়োজনীয় সংস্কার না করে নির্বাচন হলে নতুন স্বৈরাচারের উত্থান হতে পারে
অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াইয়ের ইতিহাস বেশ পুরোনো ও দীর্ঘ। যদি উদাহরণ দিতে হয় তবে চোখের সামনে ভেসে উঠে তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, দুদু মিয়ার আত্মত্যাগ তথা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২৩ বছরের অস্তিত্বের আন্দোলন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযু্দ্ধ তথা স্বাধীনতা আন্দোলন। তাছাড়া ৯০-এর দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও বাকস্বাধীনতা রক্ষার্থে ছাত্রজনতার হাসিনাবিরোধী আন্দোলন বা জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আমার আলোচনা মূলত ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে নিয়ে। অবশ্য এই জন্যে পাঠকের অনুধাবনের সুবিধার্থে একটু পিছনের অন্তনির্হিত প্রেক্ষাপটগুলোতে আলোকপাত করা প্রয়োজন। দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছিল। দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাথে তাল মিলিয়ে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে কিছুটা সক্ষমও হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ফখরুদ্দিনের সরকারের সময় দেশের অর্থনীতির স্বর্ণযুগ ছিল। যদিও এর বীজ রোপণ করে গিয়েছিলেন চারদলীয় জোট তথা বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান। প্রায় সব কিছুই আপাতদৃষ্টিতে ঠিকঠাক চলছিলো। বিপত্তি ঘটে ২০১৩ সালে। সেসসয় এক বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। অবশ্য এই রায়ে আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন এই ব্যবস্থার আলোকে করা যাবে মর্মে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছিলো। হাসিনা সরকার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে। ঐ কমিটির রিপোর্ট আর প্রকাশিত হয়নি, তবে জানা যায় যে, তারা তত্ত্বাবধায়ক বা নির্বাচনকালীন সরকার বহাল রাখার পক্ষে মতামত দিয়েছিলেন। ধূর্ত শেখ হাসিনা আদালতের রায়কে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে একতরফাভাবে ঘোষণা দিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আর ফেরত আনা সম্ভব নয়। আগামী নির্বাচন তার সরকারের অধীনেই হবে। এই ঘোষণার পর মূলত দেশের রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ এবং গোটা সমাজ ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়।
২০১৪ সালে সম্পূর্ণ এক তরফা নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনা টানা ২য় বারের মত সরকার গঠন করে এবং ২০১৮ ও ২০২৪ সালের রাতের ভোট বা নির্বাচন কেমন হয়েছিল- তা আমরা সবাই জানি। তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিটি নির্বাচনের পর স্বৈরাচারী সরকারের আত্মবিশ্বাস কয়েকগুণ বাড়তে থাকে। এভাবে লীগ সরকারের সীমাহীন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ, সন্ত্রাস, গুম-খুন, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক লুট ও অপশাসনের ফলে দেশের অর্থনীতি একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়ে। মানুষের মুখকে স্তব্ধ করতে লীগ সরকার ব্রিটিশ স্টাইলে ভাগ কর শাসন কর- নীতি হাতে নেয়। এক্ষেত্রে তারা দেশের মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে। ১. মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বা আওয়ামী লীগ ২. মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষশক্তি তথা রাজাকার।
হাসিনার ১৬ বছরের কুশাসনে, সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামলেই তাদের রাজাকার আখ্যা দিয়ে পালিত পেটুয়া বাহিনী দ্বারা হামলা করানো হতো অথবা আশীর্বাদপুষ্ট পুলিশলীগের মাধ্যমে মিথ্যা মামলা, হয়রানি এমনকি গুমের মতো কর্মকাণ্ডও ছিল হরহামেশাই। এক কথাই মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে ন্যূনতম প্রতিবাদ করলেই নেমে আসত অত্যাচারের নির্মম খড়গ। জাতির এই ক্রান্তিকালে, যে-সকল বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী জীবনের মায়া ত্যাগ করে রাজপথে আন্দোলন করেছেন এবং হাসিনার অপশাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, আমি তাদেরকে জাতীয় বীর বলতে চাই। এক্ষেত্রে দেশের প্রধান ও কার্যকর বিরোধীদল হিসেবে বিএনপি ও তার জোট এবং অন্যান্য বাম দলগুলো রাজপথে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে। তবে স্বাভাবিকভাবেই হাসিনা সরকারের সবচেয়ে নির্মম আক্রোশ ছিল বিএনপির প্রতি। হাসিনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যারা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন এবং নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের প্রতি আমি স্যালুট জানাই।
২০২৪ এর ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। ছাত্র-জনতা এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে নিয়মিত গতিতে সাবলীলভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু ক্রমেই জুলাইয়ের শেষের দিকে আন্দোলন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। জনরোষকে দমাতে কাপুরুষের মতো হাসিনা সরকার সমগ্র দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। হেলিকপ্টার থেকে নিজ দেশের জনগণের উপর চালানো হয় নির্বিচারে গুলি! মনে হচ্ছিল, দেশে যেন যুদ্ধ লেগেছে!
যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই আমার বাসা, তাই খুব কাছ থেকেই প্রতিটি ঘটনা প্রবাহের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। আন্দোলনে ঢাকাবাসীর অবদান ভুলার নয়। তারা ছাত্র-জনতার পাশে এসে দাঁড়ায়। অনেকের মত আমিও শাহবাগ, কাটাবন, এলিফ্যান্ট রোড ও সাইন্স ল্যাব এলাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের প্রতিনিয়ত পানি ও খাদ্য সরবরাহ করতে শুরু করি। আমি সেসময় তারুণ্যের উচ্ছ্বাস দেখেছি। আমি বুক ভরা আশা নিয়ে ভাবতাম, হয়ত অচিরেই এই অন্ধকার বিভীষিকাময় অবস্থার অবসান ঘটবে এবং এরাই একদিন দেশ গড়বে। আমি সেকারণে তাদের উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করি। ৫ আগস্ট দুপুরের পর হাসিনার রাজত্বের সূর্য ডুবতে শুরু করে। বাংলাদেশে রচিত হয় নতুন ইতিহাস। খুনি হাসিনা পালিয়ে গিয়ে তার নেতা কর্মীদেরও চরম বিপদে ফেলে যায়।
আমি মনে, করি জুলাই-এর চেতনা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল তা অপরিপক্বই রয়ে গেছে। আজ কোনো কোনো ব্যক্তিকে দেখে মনে হয়, তারা যেন অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার চেরাগ হাতে পেয়ে গেছে। সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলো এখনও তাদের কাজ শেষ করতে পারেনি। এই অবস্থায় প্রয়োজনীয় সংশোধন বা পরিমার্জন না করে নির্বাচন দেওয়া হলে তা বুমেরাং হতে পারে, জন্ম হতে পারে নতুন স্বৈরাচারের। যদিও ফ্যাসিবাদের বিচার শুরু হয়েছে যা, এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। বহু মানুষ হত্যা ও অসংখ্য মানুষকে আজীবনের জন্য পঙ্গু বানানোর মূল হোতাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন দেয়া উচিত হবে বলে আমি মনে করছি না।
আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য জয়ী হিসেবে বিএনপি-কে ধরা হচ্ছে। কিন্তু মানুষ আশাবাদী হতে পারছে না যে, তারা ক্ষমতা লাভের পর হাসিনার ও তার সহযোগীদের বিচার করবে বা নিজেদের লোভকে সংবরণ করতে পারবে। কেননা সালমান এফ রহমান ২০০৬ সালেও জেলে গিয়েছিলেন, এখনও জেলে আছেন। তার মতো অনেক অপরাধী আছে, যারা নির্বাচিত সরকার আসলে আঁতাত করে মুক্তি পেয়ে যায় এবং পুনরায় একই অপরাধে লিপ্ত হয়। গত ১৫ বছর গণতন্ত্র ছিলোনা, আরও ৫ বছর না থাকলে দেশের তেমন কোন ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে হয় না। প্রয়োজনে গণভোট দিয়ে সরকার জনগণের আস্থা নিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে পারে। ১৯৭১, ১৯৯০, ২০২৪ সালে সাধারণ মানুষ রক্ত দিয়েছেন শুধু ক্ষমতালোভীদের হাতে দেশের শাসনভার ছেড়ে দিতে নয়। তারা লুটপাট করবে ফলশ্রুতিতে ছাত্র-জনতাকে অধিকার আদায়ে আবার রাজপথে নামতে হবে; রক্ত দেয়ার মাধ্যমে পুনরায় হাজার হাজার মায়ের কোল খালি হবে। এগুলো এভাবে চলতে দেয়া যায় না। আগে এসবের একটা চিরস্থায়ী সমাধান হওয়া জরুরি। সেজন্যে বর্তমান সরকারকে নীতিগতভাবে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
সরকারের উচিত দেশের আলোচিত নারায়ণগঞ্জের ৭ খুন, বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা, মেজর সিনহা হত্যাসহ সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার শেষ করে রায় দ্রুত বাস্তবায়ন করে সমাজে এই বার্তা দেয়া যাতে মানুষ বুঝতে পারে, সরকার নীতির প্রশ্নে আপোষহীন । যাইহোক, হবু সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কেননা দেশ পরিচালনায় কোন প্রকার ভুল করলে তারাও ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা অনাগত সরকারকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। তা না হলে ইতিহাস তাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এবং চেয়ারম্যান, মাইক্রোমেড।
ইমেইল: jahidmilon@gmail.com