গণতন্ত্রের লড়াইয়ে ৮ বার রক্ত ঝরাতে হয়েছে, বিঁধেছে শতাধিক রাবার বুলেট
রাজনীতিতে অভিষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতায় উত্তরণ। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত হয় রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য। এর বাইরে রাজনীতিতে অন্য কোনো সমীকরণ নেই। এখন কথা হচ্ছে, ‘ক্ষমতা’ কি? ‘ক্ষমতা’ শব্দটির সাথে জুড়ে আছে ‘ক্ষমা’। অর্থাৎ ক্ষমতাবান ব্যক্তির মাঝে এই গুণটির উপস্থিতি থাকা বাঞ্ছনীয়। মানুষ ক্ষমা করতে পারে যদি তার মাঝে বিনয় থাকে। মোটকথা রাজনীতি আপনাকে বিনয়ী হতে শেখাবে; ক্ষমা করতে শেখাবে।
আজ থেকে অন্তত বিশ বছর আগে আমার কৈশোরের প্রথম ধাপে আমি রাজনীতিতে আগ্রহী হই। আমাদের সেই কৈশোর এই সময়ের চেয়ে সহস্রগুণ নির্মল ছিল- এটা বুকে হাত রেখে বলতে পারি। এর চেয়ে ভালো পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম। তবুও চারপাশে ঘটতে থাকা কিছু কিছু অসামঞ্জস্যতা আমাকে ভাবিয়ে তুলতো। আমি জানি না, সময়টা ঠিক কখন; তবে এসবের মাঝেই কখন যেন আমার মাঝে রাজনৈতিক সত্ত্বা জাগ্রত হয়ে ওঠে।
এরপর আমাকে একটা কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আমি নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে থাকলাম। জেল, জুলুম, নির্যাতনের গল্প বলে শেষ করতে পারবো না। এসবকে আমি নিয়তির উপহার হিসেবে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছি। স্থির চিত্তে নিজের করণীয় করে গিয়েছি। ইতিহাসের পাঠ নিতে গিয়ে আমি জেনেছি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাবৎ মনিষীরাই জুলুম, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সেখানে আমি এক দ্বীপ থেকে উঠে আসা নগণ্য বান্দা!
আমার যাপিত জীবনের এই অভিজ্ঞতা আমার রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। তবে এর মধ্যে দিয়ে আমার জীবনে ঘটে গিয়েছে, এক দারুণ পরিবর্তন। সীমাহীন অন্যায়, অত্যাচারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের হাস্যরসের শিকার হয়ে, বিরোধীপক্ষের দুয়োধ্বনি হজম করে এবং এককথায় একঘরে পরিণতি ভোগ করে আমার জীবনে যে উপলব্ধিটি এসেছে, তা হচ্ছে- একটি রাজনৈতিক জীবনবোধ।
আমি ক্ষমতার আস্ফালন দেখেছি; দেখেছি ক্ষমতা কিভাবে মানুষকে নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ করে; আর আমি সেই ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লড়াইয়ে, গণতন্ত্রের লড়াইয়ে সবসময় হাজির থেকে লড়াই-সংগ্রাম জারি রেখেছি। এই লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে আমাকে অন্তত ৮ বার রক্ত ঝরাতে হয়েছে। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছি ৭ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে। চোখের সামনে মকবুলকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছি; নিজের মাথা, পা আর পিঠে বিঁধেছিল শতাধিক রাবার বুলেট। এখনো পায়ে, মাথায় সেসব বুলেটের ব্যথা নিয়ে পথ চলছি। বাঁ পাজরে স্মৃতি স্মারক হিসেবে রয়ে গিয়েছে বিরাট এক দাগ। ঘাতকের শর্টগান থেকে ছোঁড়া সেই গুলিটি আরেকটু উপরে লাগলে হয়তো সেটাই হতো আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস। টানা তিন মাস আমাকে জেলখানার চার দেয়ালে নিঃসঙ্গ ট্রমা বয়ে বেড়াতে হয়েছে। দুঃসহ সেসব সন্ধ্যাগুলো মনে পড়লে এখনো চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তবুও ক্ষমা করার চর্চাটাকেই মনেপ্রাণে ধারণ করি।
আরও পড়ুন: রাজধানীসহ সারাদেশে বিক্ষোভের ডাক ছাত্রদলের
আমি জানি, আমার মতো হাজারো বিএনপি নেতাকর্মীর জীবনে এই ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছে অন্যায়, অবিচার, গণতন্ত্রহীনতার প্রতিবাদ করার কারণে। আমি বিশ্বাস করি, যারা এই অবর্ণনীয় জুলুম, নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, তারা উপলব্ধি করতে শিখেছেন- কোন ক্ষমতা তাদেরকে এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা দিয়েছে! এই উপলব্ধি যাদের আছে বা হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই ক্ষমতার ইতিবাচক অর্থ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করবেন; রাজনীতির প্রকৃত বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করতে শিখবেন।
আমি বিশ্বাস করি, নিপীড়কের বিরুদ্ধে লড়াই করা কেউ নিপীড়ক হওয়া, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়ানো এবং গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে অগণতান্ত্রিক আচরণ করা কখনোই কাম্য নয়। আবারও বলছি, সমাজে ক্ষমা করা চর্চা বাড়াতে হবে।
এই বাংলাদেশটা আমাদের সবার। ফ্যাসিবাদের কবলমুক্ত এই বাংলাদেশকে সুন্দর, আলোকময় করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে আধুনিক ও উৎপাদনমুখী বাংলাদেশ গড়ার ভীত রচনা করে দিয়েছিলেন, তা প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব প্রতিটি রাজনীতিবিদের। বেগম খালেদা জিয়া যে গণতন্ত্রের জন্য আপসহীন সংগ্রাম করে গিয়েছেন, তার সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব প্রতিটি গণতান্ত্রিক নাগরিকের। তারেক রহমান যে বেটার বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তা গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রতিটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বলিষ্ঠ নাগরিকের।
আসুন, আমাদের বাংলাদেশকে আমরাই গড়ে তুলি। কোনো ভারতপন্থি নয়, পাকিস্তানপন্থি নয়, মার্কিন বা চীনপন্থি নয়; বাংলাদেশ নিরাপদ থাকুক বাংলাদেশপন্থিদের হাতে। আমাদের রাজনীতি হোক মানবিক, সমতাভিত্তিক ও সহনশীলতার।
লেখক: ফারহান আরিফ
যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, কেন্দ্রীয় সংসদ।