১০ জুন ২০২৫, ১১:১৬

ত্যাগ, আত্মশুদ্ধি ও ঐক্যের উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা

প্রতীকী  © সংগৃহীত

অফুরন্ত আনন্দের সওগাত ও ত্যাগের মহিমা নিয়ে আসা পবিত্র ঈদুল আযহা খোদাভক্তি, আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির মহিমায় ভাস্বর। মানবজীবনের গভীরতর উপলব্ধি, আত্মনিবেদন ও আত্মশুদ্ধির প্রতীক হয়ে প্রতি বছর আমাদের সামনে উপস্থিত হয় মুসলিম জাতির অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আযহা। এখানে ‘ঈদ’ শব্দের অর্থ উৎসব বা আনন্দ। আর ‘আযহা’ অর্থ ত্যাগ বা উৎসর্গ করা। যেহেতু এই ঈদের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তাঁর নামে ও উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করা, এজন্য একে কোরবানির ঈদও বলা হয়। ‘কোরবানি’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো নৈকট্য অর্জন করা। পরিভাষায়—কোরবানির উৎসর্গকৃত পশু, যা একমাত্র আল্লাহর নির্দেশে, তাঁর সান্নিধ্য লাভের সার্থক প্রচেষ্টার আর্থিক আনন্দ—তাই ঈদুল আযহা। এ দিনে বিশ্বের লাখো-কোটি মুসলিম বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহান স্রষ্টার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও হজরত ইসমাইল (আ.)-এর অতুলনীয় ত্যাগ ও কোরবানির আদর্শকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

আধ্যাত্মিক বিপ্লবের স্মারক পবিত্র ঈদুল আজহা’র সূচনা খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে আদি পিতা আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানির ঘটনার দিকে। সেই থেকেই কোরবানি এক ধারাবাহিক ধর্মীয় অনুশীলন হিসেবে বিভিন্ন উম্মতের ওপর কার্যকর ছিল। সব নবীর উম্মতের মধ্যেই অবিচ্ছিন্নভাবে কোরবানির ধারাবাহিকতা চলে আসছে তথা সব নবীর উম্মতকেই কোরবানি করতে হয়েছে। প্রত্যেক নবীর উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ। মানবসভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোন না কোনভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে। এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব।

বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর ওপর যে কোরবানির বিধান আরোপিত, তার মূল উৎস ইবরাহিম (আ.)-এর অসাধারণ আত্মত্যাগের ঘটনায় নিহিত। তিনি আল্লাহর নির্দেশে তাঁর প্রিয় শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হন। এই ঘটনার পটভূমি মক্কার জনমানবশূন্য প্রান্তর ‘মিনা’। সেখানে ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)—পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকা সেই আত্মত্যাগের স্মৃতিকে কেন্দ্র করেই আজও বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা পালন করে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ।
এই ঈদের মূল দর্শন দুটি— ১. আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন, ২. কোরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে সামাজিক সাম্য ও সম্প্রীতির ভিত্তি নির্মাণ।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন— “তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো।” — সুরা কাওসার, আয়াত ২
জাহেলি যুগে কাফির ও মুশরিকরা তাদের মূর্তি, দেবদেবী ও কবরের উদ্দেশে পশু উৎসর্গ করত। ইসলাম সেই ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কুসংস্কারের প্রতিবাদ জানিয়ে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করার বিধান দিয়েছে। সালাত ও কোরবানি—দুটি ইবাদতের মাধ্যমে একজন মুমিন তাঁর ঈমানের পরিচয় দেন।

জিলহজ মাসে হজ পালনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান সমবেত হন মক্কা মুকাররমা, মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায়  ইবরাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার জীবন্ত নিদর্শনে। এই মিলনমেলায় বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্বের শক্তিশালী চেতনা গভীরভাবে অনুভূত হয়।

ঈদুল আজহা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—এই দুনিয়ার ধন-সম্পদ, প্রিয়জন, এমনকি আমাদের জীবন পর্যন্ত—সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া। সুতরাং তাঁর রাহে যে কোনো ত্যাগ আমাদের জন্য সম্মানের বিষয়। কোরবানির সময় আমরা পাঠ করি পবিত্র কোরআনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত— “বলুন, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ—সবই আল্লাহ, জগতসমূহের প্রতিপালকের জন্য।” — সুরা আনআম, আয়াত ১৬২–১৬৩

আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা আনন্দঘন পরিবেশে ঈদুল আজহা পালন করে। এদিন মুসলমানরা খুশির এক মোহনায় এসে মিলিত হয়। ঈদুল আজহার দিন সকালে ওয়াজিব নামাজ আদায় করে। তারপর পশু কোরবানি করে। ঈদের নামাজ আদায় ও কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ লাভ করে। ঈদুল ফিতরের আমেজ কাটতে না কাটতে আসে ঈদুল আজহা। এই ঈদের বড় কাজ হলো কোরবানি করা। নেক আমলগুলোর মধ্যে কোরবানি একটি বিশেষ ইবাদত।কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা হয়। আল্লাহর আদেশ থাকার কারণে মুসলমানরা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য এই আদেশ পালন করে। পশু কোরবানি করা মুখ্য বিষয় নয়; বরং আল্লাহভীতিই এখানে মুখ্য বিষয়। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন : ‘আমার কাছে পশুর রক্ত, মাংস, হাড় ইত্যাদি কিছুই পৌঁছায় না। পৌঁছায় শুধু তোমাদের অন্তরের তাকওয়া বা ভয়ভীতি।’ আমরা কোরবানির মাধ্যমে কে কতটুকু আত্মত্যাগ, আল্লাভীতির পরিচয় দিচ্ছি এবং আল্লাহর পবিত্র আদেশ কতটুকু পালন করছি, আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন।

প্রতিবছর কোটি কোটি মুসলমান এই দিনে পশু কোরবানি করেন। বাংলাদেশেও শহর-গ্রাম নির্বিশেষে ঈদুল আজহার প্রস্তুতি চলে মহা উৎসাহে। কোরবানির পশু কেনা, পরিচর্যা, কোরবানি করা ও মাংস বিতরণ এসব কাজের মধ্যে শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মানবিক মূল্যবোধের বাস্তব অনুশীলন।

ইসলাম কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করার নির্দেশ দেয়—এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের জন্য এবং এক ভাগ গরিব-দুঃখীদের জন্য। এ ব্যবস্থায় ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ঘুচে গিয়ে তৈরি হয় সমতা, সহানুভূতি ও সহাবস্থানের এক অনন্য চিত্র। দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই যেন এই উৎসবের সবচেয়ে বড় অর্জন।

ঈদুল আজহা কেবল ১০ জিলহজ নয়, বরং সারাবছরকার জীবনের জন্য একটি শিক্ষা। এই শিক্ষা হল—"আমি কতটা ত্যাগ করতে পারি অন্যের মঙ্গলের জন্য?", "আমার মধ্যে কতটা সহানুভূতি আছে?", "আমি নিজের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে কতদূর এগোতে পারি?" ঈদুল আজহা আমাদের সামনে এই প্রশ্নগুলো তোলে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই উৎসবের চেতনাকে যদি ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া যায়—তবে আমাদের সমাজ হতে পারে একটি সহনশীল, মানবিক ও সাম্যবাদী রাষ্ট্রের প্রতীক।

আরও পড়ুন: শহীদ ও আহত পরিবারের মাঝে শাবিপ্রবি শিবিরের কোরবানির গোশত বিতরণ

বর্তমান সময়ে মুসলিম বিশ্ব যখন বিভাজন, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—তখন ঈদুল আজহার চেতনা হয়ে উঠতে পারে এক শক্তিশালী ঐক্যের বার্তা। যারা আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিমি ত্যাগকে স্মরণ করে, তারা কীভাবে বিভক্ত থাকে? ঈদুল আজহা আমাদের শেখায়, “ঐক্যই শক্তি”—এবং সত্যিকারের ঈমান সেই শক্তিকে ধারণ করে।
ঈদুল আজহার বা কোরবানি মূলত আমাদের আত্মত্যাগের পরীক্ষা, আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন এবং মনের সমস্ত কুপ্রবৃত্তিকে পরাজিত করার এক পবিত্র সাধনা। কোরবানি দিয়ে পশু জবেহ করা কেবল বাহ্যিক কাজ; প্রকৃত কোরবানি হল মন থেকে হিংসা, লোভ, মোহ, ক্রোধ, পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষ ইত্যাদি পশুশক্তি বিলুপ্ত করা। এই আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মুসলিম সমাজে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতির বন্ধন জোরদার হয়।

আল্লাহর উদ্দেশে আমাদের সকল কিছু উৎসর্গ করার প্রস্তুতির একটি প্রতীক ঈদুল আজহার মধ্য দিয়ে যেন আমরা এই আত্মত্যাগ ও নিঃস্বার্থতার শিক্ষা জীবনে ধারণ করি, আর সমাজে ছড়িয়ে দিই মানবতা, সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্বের আলো। ঈদুল আজহার দর্শন প্রতিটি মানুষের জীবনে কার্যকর হতে পারে যদি তা ব্যক্তি থেকে সমাজে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। একজন মুসলিম ঈমানদার যদি তার আত্মা, চিন্তা ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এই ত্যাগ, ধৈর্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে ধারণ করতে পারে, তবেই এ উৎসবের প্রকৃত মূল্যায়ন হবে।


লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।