ডাকসু নির্বাচন: শিক্ষার্থীরা যেন আশাহত না হন
দীর্ঘ ২৮ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) মরিচা পড়া তালা আবার খুলতে যাচ্ছে। সোমবার (১১ মার্চ) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে অনেক প্রত্যাশার এ নির্বাচন। এ উপলক্ষে দীর্ঘদিন পর যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আশায় বুক বেঁধেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন ধরে তাদের বুকের ওপর থেকে জগদ্দল পাথর এবার সরতে পারে এমনটাই প্রত্যাশা তাদের। নির্বাচনের প্রার্থীরাও তাদের নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, নির্বাচিত হলে দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো সমাধানের আশ্বাস দিচ্ছেন। সবমিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন হয়তো মনে করছেন, তাদের প্রাণের দাবিগুলো পূরণ হতে চলেছে।
তবে বাস্তবতা কতটা তাদের পক্ষে থাকবে, সেটা নিয়ে এখন প্রশ্ন তোলাই যায়। যে প্রত্যাশার পাহাড় তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে তা আসলে কতটা পূরণ হতে পারে? শেষ পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচন কি আলোর মুখ দেখবে, নাকি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আশাহত হবেন না তো? ডাকসু নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, এ প্রশ্নগুলোও কিন্তু ততই জোরালো হচ্ছে।
ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত দুই মাসের মধ্যে ইতিবাচক অনেক কিছুই ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ২০১০ সালের পর প্রথমবারের মতো ক্যাম্পাসে তথা মধুর ক্যান্টিনে গেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সৌহার্দ্য বিনিময় করতেও দেখা গেছে। এখন নিয়মিতই ক্যাম্পাসে যাচ্ছে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। অথচ গত প্রায় ৯ বছরে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলেই মারধরের শিকার হতেন। সেক্ষেত্রে এখনকার পরিস্থিতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি নিঃসন্দেহে। তবে ফল যাই হোক, নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে সংশয়ে কিন্তু অনেকেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে অন্তত ছয়-সাত বছর ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে। সে সময় দেখেছি, রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। এক প্রকার দূরত্ব তাদের মধ্যে ছিল বলা চলে। কিন্তু এখন ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষে দূরত্বটা কমেছে অনেক। ওই নেতারাই এখন যাচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে। বিনয়ের সঙ্গে ভোট চাচ্ছেন। এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে অনেককে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও স্ট্যাটাস দিতে দেখা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবসময়ই এমন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকাটাই প্রত্যাশিত। ডাকসু নির্বাচন এ চাহিদা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও পূরণ করেছে বলা চলে।
গেস্টরুম নির্যাতন, অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করা, তীব্র আবাসন সংকট, খাবারের নিম্নমান, পড়াশোনার প্রতিকূল পরিবেশ, লাইব্রেরি সমস্যা, মাদক, শিক্ষকদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা না পাওয়া, পরিবহনের অপ্রতুলতা, নিরাপত্তাহীনতা, আর্থিক সংকট, বহিরাগতদের আগমনসহ এমন হাজারো সমস্যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে। দীর্ঘদিন ধরেই এগুলো চলে এলেও তা সমাধানে কোথায় যাবেন, তা ভেবে কোনো কূলকিনারা তারা পেতেন না। তবে ডাকসু নির্বাচন কিন্তু তাদের কথা বলার জায়গাটা করে দিয়েছে।
এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যাগুলো খোলাখুলিই বলছেন। এক্ষেত্রে হালের ট্রেন্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারই বেশি হচ্ছে। সেখানে তারা তাদের সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরছেন। সমাধানের জন্য ডাকসুকে একটি উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবেই মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। ইতিবাচক ব্যাপার হলো, সাধারণ শিক্ষার্থীদের এসব সমস্যার সমাধানকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থীরা। এ বিষয়গুলো সামনে রেখেই তারা ভোট চাচ্ছেন ভোটারদের কাছে। ইশতেহারেও তা ফুটে উঠেছে। খুঁজে ফিরলে এমন হাজারো ইতিবাচক দিক খুঁজে পাওয়া যাবে এবারের ডাকসু নির্বাচন ঘিরে। তবে এ নির্বাচনের ব্যাপারটি যতটা সহজভাবে ভাবা হচ্ছে, ততটা সহজভাবে কি চলছে? এ পর্যন্ত নির্বাচনের প্রার্থীরা যতগুলো অসংগতি তুলে ধরে সমাধানের দাবি জানিয়েছেন তার অধিকাংশই পূরণ হয়নি। বিশেষ করে আবাসিক হলে ভোটকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি রয়েছে অধিকাংশ ছাত্র সংগঠনের। ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন করে আলোচনায় আসা ঢাবির সান্ধ্যকালীন কোর্সের ছাত্র ওয়ালিদ আশরাফও এ দাবিতে ফের অনশন করেছেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও দাবি এমনই, যা গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে। যদিও ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো আপত্তি আসেনি। এ দাবির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও কোনো কর্ণপাত করেনি।
আর এ নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হলো ডাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনের জন্য মাত্র ছয় ঘণ্টা সময় পাবেন শিক্ষার্থীরা। ডাকসুর কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ নির্বাচনে মোট প্রার্থী রয়েছেন ৭৩৮ জন। প্রত্যেক ভোটারকে কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫টি এবং হল সংসদে ১৩টিসহ মোট ৩৮টি ভোট দিতে হবে। বিশাল এ কর্মযজ্ঞ সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত মাত্র ছয় ঘণ্টায় শেষ করতে হবে। এই সময়ে ৪৩ হাজার ২৫৬ শিক্ষার্থীর ৩৮টি করে ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ৭২৮টি ভোট গ্রহণ করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে! ব্যাপারটি কীভাবে সম্ভব সে বিষয়ে এখনও কোনো যুক্তিযুক্ত বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন কি না, বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাড়া অধিকাংশ প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছ থেকেই ভোট গ্রহণের সময় তিন থেকে চার ঘণ্টা বৃদ্ধির দাবি জানানো হয়েছে।
যেসব প্রার্থী এ দাবি জানিয়েছেন তাদের মতে, প্রতি ভোটারকে গড়ে ৭-৮ মিনিট করে দেওয়া হলেও সব শিক্ষার্থী ভোট দিতে পারবেন না। অধিকাংশ হলের প্রয়োজনীয় সংখ্যক বুথও করা সম্ভব হবে না। তবে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় দিলে সবার ভোট দেওয়ার সুযোগ হবে বলে তারা মনে করছেন। এ বিষয়টি সামনে আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বারবার তা এড়িয়ে গেছে। তবে প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নির্ধারিত সময়ে লাইনে দাঁড়ালে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে। এটা নিয়ে আশাবাদী অনেক প্রার্থী অন্তত সব ভোটারের ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন। কারণ যেসব শিক্ষার্থী হলের বাইরে থাকেন এবং ভিন্ন মতাবলম্বী তারা ভোট দিতে পারবেন কি না, তা নিয়েই প্রার্থীদের ভয়টা বেশি।
ডাকসুর নির্বাচনী প্রচারণায় আচরণবিধি লঙ্ঘনেরও অভিযোগ উঠেছে। রঙিন পোস্টারের মাধ্যমে ভোট চাওয়া, মসজিদে দাঁড়িয়ে ভোট চাওয়াসহ একাধিক অভিযোগ এসেছে। এখানেও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ বেশি। এমনকি বিরোধী প্রার্থীর ব্যানার খুলে নেওয়ার মতো অভিযোগও এসেছে তাদের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়েও খুব বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কর্তৃপক্ষকে। সবমিলিয়ে ডাকসু নির্বাচন প্রক্রিয়ার পথ খুব বেশি মসৃণ ছিল, তা বলা যাবে না। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরুর আগে ব্যাপারটি আইন-আদলত পর্যন্তও গড়িয়েছে। তবে ডাকসু নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে সব বিতর্ক উড়ে যাবে বলে মত অনেকেরই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয় ডাকসুকে। নেতৃত্ব তৈরির কারখানাও এটি। অতীতে এ প্রতিষ্ঠানটিকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। তবে দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় সে প্রক্রিয়া ব্যাপকহারে ব্যাহত হয়েছে সন্দেহ নেই। দেশের ছাত্র রাজনীতিতেও পরিবর্তন এসেছে অনেক। তবে এখন ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। এটি সফলভাবে শেষ হলে তা বর্তমান প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে বড় সফলতা হবে নিঃসন্দেহে।
অনেকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে ডাকসু নির্বাচনকে মেলাতে চান। এটি নিয়ে কিছুটা নৈরাশ্যবাদীও তারা। তবে আমি সে দলের সমর্থক নই। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা এখানে পড়াশোনা করেন। জাতীয় পর্যায়ের অনেক কিছুতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণে হতে যাওয়া ডাকসু নির্বাচন ভালোভাবেই সম্পন্ন হবে বলে আশা করি। কারণ এখানে কোনো ধরনের নেতিবাচক ঘটনা ঘটলে তা প্রায় ৪৩ হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীকে আশাহত করবে সন্দেহ নেই। সংশ্লিষ্টদের মনে রাখা জরুরি, এই শিক্ষার্থীরাই কিন্তু উচ্চশিক্ষিত হয়ে আগামী দিন দেশের হাল ধরবেন। তাদের সঙ্গে নেতিবাচক কোনো ঘটনা ঘটে গেলে ফল খুব বেশি ভালো হবে না বোধহয়।
গত ২৮ বছরে বেশ কয়েকজন উপাচার্য ডাকসু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পূরণ করেননি। তবে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান সে ধারা থেকে বেরিয়ে এসে ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছেন বলা চলে। তবে ইতিহাসে কিন্তু দুভাবে স্মরণীয় হওয়ার সুযোগ রয়েছে, এটাও মনে রাখা দরকার। এক্ষেত্রে তিনি যদি সঠিক পন্থায় ও সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিকভাবে ডাকসু নির্বাচনের প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর অধিকার তার মাধ্যমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যথায় এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীকে আশাহত করার কারণ হবেন তিনি। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ডাকসু নির্বাচনের সার্বিক প্রক্রিয়া সফলভাবে তিনি শেষ করবেন বলেই প্রত্যাশা। সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্র সংগঠন, প্রার্থী, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছ থেকেও এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাটাই কাম্য। বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে ডাকসু নির্বাচন সফলভাবে শেষ হোক-সবশেষে সেই প্রত্যাশাই থাকল।
গণমাধ্যমকর্মী
touhiddu.rahman1@gmail.com