ভোট আটকে ‘ফ্যাসিস্ট’ হতে যাচ্ছে ওরা?

সাইদুর রহমান
সাইদুর রহমান  © সংগৃহীত

প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতায় আর ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বড় হতে হতে অনেকেই ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। প্রকৃত মানুষ হতেই ভুলে গেছে। ক্ষমতার মোহে পড়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। প্রতিবাদের পরিবর্তে অন্যায়, অবিচার, দুঃশাসন, লুটপাটতন্ত্র, খুন-গুমের রাজনীতি মেনেই বড় হয়েছে। শূন্য থেকে ২৫ বছর বয়সী প্রজন্মের (সবাই নন) তরুণ-তরুণীরা প্রত্যক্ষ করেছে, ভোট মানে জবরদস্তি, ক্ষমতা মানে ভোগ।

প্রায় আড়াই কোটি ভোটারের এই প্রজন্ম আওয়ামী লীগের গালিগালাজ শুনে মানুষ হয়েছে। এই প্রজন্মের ক্ষুদ্র অংশ হয়তো ভোটের ব্যাপারে সোচ্চার কিন্তু বেশির ভাগ ভোট চায় না। কারণ এরা বিগত আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে ছিল। নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের লুঙ্গির ভেতরে লুকিয়ে থাকে। যারা বিপ্লবী ছিলেন, তারা এখনো শিরদাঁড়া খাড়া করে গণতন্ত্রের জয়গান গেয়ে যাচ্ছেন।

খেয়াল করবেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের আগে ওই অংশটি কখনোই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি, ভোটাধিকার নিয়ে কথা বলেনি। এই অংশটির বেশির ভাগের হাতে আছে স্মার্টফোন। যে ফোনে তারা অতিরিক্ত সক্রিয়, আসক্ত। আওয়ামী লীগ স্টাইলে বেপরোয়া। যেকোনো বিষয়ে কেয়ারলেস। ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে মরিয়া। বাংলাদেশ থেকে ফ্যাসিবাদ শাসনের পতন হলেও তাদের সহযোগীরা রয়ে গেছে। ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শূন্যতায় অনেকেই জায়গা নিয়েছে। নতুন ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পুরাতন ফ্যাসিস্টদের ভাষায় কথা বলছে। নির্বাচন আটকে মাঠের রাজনীতির পরিবর্তে সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে জ্ঞান বিতরণ চালিয়ে যাচ্ছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় এ জন্য বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছে। হাজার হাজার ভুয়া আইডি খুলে ভোট-বিরোধী প্রচারণায় জড়িয়ে পড়েছে। কেউ নির্বাচনের কথা বললেই ব্যক্তিগত আক্রমণ করছে। স্বনামে যেসব আইডি আছে, তাদের বেশির ভাগ আবার ৫ আগস্টের আগের সব কোনো পোস্ট ডিলিট করেছে। এটির কারণ নিজেরা তখন তো ফ্যাসিবাদের গর্ভে লালিত-পালিত হয়েছে। বেশির ভাগ আকর্ষণীয় ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে তোলা ছবিও হাওয়া হয়ে যায়। দ্বিচারিতা সম্পন্ন এই প্রজন্মকে চিনে রাখুন। এরা সুবিধাভোগী, রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। এরা গণতন্ত্রবিরোধী, দেশবিরোধী। এরা ফ্যাসিস্টের নতুন সংস্করণ।

জুলাই-আগস্টের গণবিপ্লবে ফ্যাসিস্ট বিদায়ের পর বিএনপিকে টার্গেট করে রাজনীতি শুরু করে। জন্মের পর থেকেই তো ওরা বিএনপি-বিরোধী। ওরা ভোট-বিরোধী। ওদের হাতেই বৃদ্ধরা ভোট-বঞ্চিত হয়েছে। বিএনপিকেও বিতর্কিত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার স্বপ্নে বিভোর ছিল। বিএনপির সম্পর্কে ফ্যাসিস্টের শেখানো বুলি মাঠে ঝেড়ে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের মতো কিন্তু রাজনীতির মাঠে জনগন থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পেয়ে বা ধিক্কৃত হয়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে।

সত্য বা মিথ্যা যাচাই-বাচাই ছাড়াই মিথ্যা ডেলিভারি দিচ্ছেন, সাময়িক বাহবাহ নিচ্ছেন। কিন্তু প্রকারান্তরে নিজেদের ক্ষতি করছেন। এই প্রজন্মের (সবাই নন) মূল টার্গেট হাসিনার মতো দেশে নির্বাচন আটকানো। নির্বাচন আটকে নিজেদের আখের গোছানো। সেই কাজেই তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া আর মাঠের রাজনীতি যে এক জিনিস নয়, এটি বোঝার মতো সক্ষমতা নেই এসব ভোট বন্ধকারীর।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয় ১৯৮৬, ১৯৮৮ সালের পরপর দুটি বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনের কারণে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সংঘটিত হয়েছিল ২২ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আর শেখ হাসিনার পতন হয়েছে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে।

নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবস্থাপনাকে জাদুঘরে পাঠিয়ে কোনো শাসক বা গোষ্ঠী পৃথিবীতে শাসনভার পরিচালনা করে টিকে থাকতে পারেনি। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো সংস্কারের প্রথম এবং সবচেয়ে মূল্যবান সংস্কার।

নির্বাচন না হলে কীভাবে বাংলাদেশের সংস্কার হবে? কীভাবে জনগণ তার মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবে? দীর্ঘদিন নির্বাচন আটকে জনগণের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার পরিণাম ভয়ংকর খারাপ হবে। যারা জনগনের কথা বলে নির্বাচন আটকাতে চাচ্ছে, এই জনগণ কারা জানেন? এরা সুনির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর, মুষ্টিমেয়। যারা মোট জনগণের মাত্র ১০ শতাংশও প্রতিনিধিত্ব করে না। অতএব নির্বাচন আটকানোর স্বপ্ন যারা দেখছেন, তাদের কপালে দুুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছে। আওয়ামী লীগের মতো নব্য ফ্যাসিস্ট হওয়ার চিন্তা করা হবে মহাবিপজ্জনক।

দেশে নির্বাচন হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, জনগণ তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে। জনগণের ক্ষমতায়ন হবে। ক্ষমতার অংশীদার হবে। নিজের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবে। উল্লেখ্যযোগ্য সংস্কার হবে, চিরতরে ফ্যাস্টিস নির্মূল হবে। জনগণ সুশাসন ফিরে পাবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়ের মধ্যেই দেশে নির্বাচন দিতে হবে। অবিলম্বে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী ট্রেনে ওঠাতে হবে। দেশের মানুষকে নির্বাচনমুখী করতে হবে। এর বাইরে যারা দেশ নিয়ে, নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করবে, তারা এই বাংলাদেশকে ধারণ করে না। তারা হয় ভারত নতুবা পাকিস্তানের মিত্র। এই মিত্র নাগরিকরা প্রকৃত বাংলাদেশিদের শত্রু। তারা বাংলাদেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে, কিন্তু জনগণ তাদের কঠোর হাতে প্রতিবাদ করবে। রাজপথে কঠিন জবাব দেবে।

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা টিকে থাকার একমাত্র হাতিয়ার, এটি বোঝার সক্ষমতা ওদের অর্জন করতে হবে আগে। সবাইকেই ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণবিপ্লবকে ধারণ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। তবে নতুন বাংলাদেশ বির্নিমাণে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না।

লেখক : রাজনীতি এবং নির্বাচন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক


সর্বশেষ সংবাদ