চারিদিকে নব্য ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি
আবারো চেতনার ব্যবসা। যে চেতনা বিক্রি করে দেশটাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছিল। চেতনা ছিনতাই করে অপব্যবহার করা যে কত মহাপাপ সেটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে পতিত আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের পৈত্তিক সম্পত্তি মনে করে বিগত ১৫টি বছরের দেশে ফ্যাসিবাদ শাসন কায়েম করেছিলো। তেমনি বর্তমান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের চেতনা ছিনতাই করবার চক্রান্তে লিপ্ত। ৫ আগস্টকে নিজেদের পৈত্তিক সম্পত্তি ভেবে যাচ্ছে তাই করতে যাচ্ছে। সেই বিতর্কিত আওয়ামী লীগের পদানুসরণ হবে চরম বোকামি।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কিংস পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ লক্ষ্যে ফান্ড গঠনের কার্যক্রম চলমান। টার্গেট ১ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিপুল টাকা সংগ্রহ অভিযান চলমান রয়েছে। এমনকি বড় বড় কিছু নিয়োগ কার্যক্রমের মাধ্যমেও অর্থ সংগ্রহ কার্যক্রমের কথাও শোনা যাচ্ছে। সয়াবিন তেলের দামি বাড়িয়ে অর্থ আদায় হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের সার্ভার হ্যাক করে চাঁদাবাজির অভিযোগও পাওয়া গেছে। দুই ছাত্র সমন্বয়কের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেয়ার জন্য একজন পুলিশ সুপারকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি রাখা হয়েছে।
যেহেতু ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ শাসনের পতন হয়েছে সেহেতু অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার তাদের নেতৃত্বে হবে-সেটাই স্বাভাবিক। বর্তমান সরকার এককভাবে পরিচালনা করেও যাচ্ছে ছাত্ররা। ৫ আগস্টকে নিজেদের আন্দোলন আখ্যা দিয়ে মাস্টারমাইন্ড, সুপার হিরো নানা উপাধিতেও ভূষিত করা হচ্ছে। দেশের জনগণের ভাগ্যের উন্নয়নের কিছুই হচ্ছে না। জনগণ যে দ্রুত ভোট দিতে চায় সেই উপলব্ধি নেই তাদের ভেতরে। বরং ক্ষমতার মোহে পড়ে গেছে।
আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, ৫ আগস্ট কিন্তু একদিনে বা একমাসে হয়নি। বিগত ১৭ বছরের সরকার বিরোধী আন্দোলনের পটভূমির চূড়ান্ত রূপ জুলাই-আগস্ট। বিএনপি-জামায়াতের উপর চরম নির্যাতন, নিপীড়ন, দমনপীড়ন করে ক্ষমতায় আঁকড়ে ছিল আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছিল। হরণ করা হয়েছে ভোটের অধিকার। বিগত ১৭টি বছর রাজপথে লড়াই করে গেছে বিএনপির নেতৃত্বে মুক্তিকামী রাজনৈতিক দলগুলো। জেল-জুলুম, হত্যা, গুম এবং হাজার হাজার শহীদের রক্তের উপর ভিত্তি করেই ৫ আগস্ট।
ছাত্ররা যেহেতু বর্তমান ক্ষমতায় তাদের মূল কাজ হওয়ার কথা ফ্যাসিবাদের কবল থেকে বাংলাদেশকে পুরোপুরি মুক্ত করা। প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। আমাদের বুঝতে হবে যে, এই সরকারের জনগণের কোন ম্যান্ডেট নাই। দীর্ঘদিন অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশে বিশৃঙ্খলা, অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে। সরকার ব্যর্থ হয়ে গেলে জুলাই-আগস্টও ব্যর্থ হয়ে যাবে। অনির্দিষ্টকাল খাদের কিনায় পড়ে যাবে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি।
তাহলে কিসের আশায়, কিসের মোহে কেন নির্বাচন বিলম্বিত করতে হবে? কেন আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন দেয়া যাবে না? কেন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রাজনৈতিক দল করতে হবে? কেন মুক্তিকামী দলগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে আক্রমণ করতে হবে? কেন পর এক অনৈক্য সৃষ্টি করে অনিশ্চিত পরিবেশ তৈরি করতে হবে? কেন সরকার পরিচালনায় যুক্তরা স্বচ্ছ থাকবেন না? কেন সব সংস্কার আপনাদের করতে হবে? নতুন দলের নামে কেন ফ্যাসিবাদ শক্তি পুর্নবাসন করতে হবে? নির্বাচিত সরকার কোন দল আসবে তা নিয়ে কেন ভাবতে হবে? কে প্রধানমন্ত্রী হবেন সেটিও কেন ঠিক করতে হবে? জনগণকে কেন আবার ক্ষমতাহীন করতে হবে?
যদি বা কিন্তু ধরেই নেয় উপরের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সঠিক। তাহলে বাংলাদেশের জনগণ তো নতুন ফ্যাসিবাদ পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। জনগণতো আবারো নতুন করে অধিকার হারাবে। এজন্য হয়তো নির্বাচনের কথা শুনলে আপনাদের ঘা জ্বালা করে। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা দিতে ভয় লাগে। নির্বাচন নিয়ে আপনারা ইতিমধ্যে জনগণকে যদি বা কিন্তুতেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন। তেমনি আপনারা কেন পুরো রাষ্ট্রটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন? নির্বাচন আটকিয়ে নতুন ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হবে আত্মঘাতী। কাররণ এক ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানো হয়েছে আরেক নব্য ফ্যাসিবাদের উত্থানের জন্য নয়।
বাংলাদেশে বিগত ২০০৭ সালের এক এগারোর মতো বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজনীতিবিদদের চরিত্র হরণ শুরু হয়েছে। জোর করে দেশ শাসন করতে গেলে প্রতিবাদ হবে, বাধা আসবে। সরকার কর্তৃত্ববাদ হয়ে উঠবে। তখন বাধ্য হয়েই মুক্তিকামী রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের অধিকার ফেরাতে মাঠে নামবে।
ছাত্রদের দায়িত্ব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেশে নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র সংস্কার করবে। আপনাদের পরামর্শ গ্রহণ করবে। যদি সেই সরকার বাংলাদেশের গুণগত পরিবর্তন করতে না পারে তারাও জনধিকৃত হবে। জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস। ক্ষমতা জনগণের উপর ছেড়ে দিন। জনগণের প্রতি ভরসা রাখুন। বাংলাদেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে এই মুহূর্তে দরকার জনগণের সরকার।
লেখক: রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক