তরুণদের বড় অংশই মেধা-যোগ্যতা শেষ করেছে সরকারি চাকরির পেছনে
বুয়েট বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা মেডিকেল থেকে পাস করা ডাক্তার, কোন বিজ্ঞানী কিংবা শিক্ষকের বদলে প্রশাসন, পুলিশ বা সাধারণ ক্যাডারের দাম যে রাষ্ট্রে বেশি, সেখানে সবাই নিজ নিজ পেশা ছেড়ে এসব আমলা হওয়ার চেষ্টা করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আসলেই যদি সমাধান চান, তাহলে সমস্যার গোড়ায় হাত দেন। সব পেশার যথাযথ মর্যাদা দেন।
কেউ স্বীকার করুন বা নাই করুক এই দেশে এখনও স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। উচ্চমাধ্যমিকের পর তাদের থেকে সবচেয়ে মেধাবীরা বুয়েট মেডিকেলে যায়। সেই তুলনায় পরের সারির ছেলেটা মানবিকে বা কমার্সে পড়ে। এদের মধ্যে মেধাবীরা আবার আইন, বিবিএ বা অর্থনীতির মতো বিষয়গুলোতে পড়ে। অথচ চাকুরির বাজারে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ, বিবিএ গুরুত্বপূর্ণ নয়, এখানে যার যে বিষয়ই থাকুক না কেন প্রশাসন বা পুলিশ বা সাধারণ আমলাদের দামই সবচেয়ে বেশি। ফলে সবাই সেদিকেই ঝুঁকছে।
আজ থেকে ১৪-১৫ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, কলা বা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের যে ছেলেমেয়েগুলো কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে ভর্তি হতে পারতো না তাদের অনেকেই প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়। অন্যদিকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কিংবা কৃষি বা বিজ্ঞানে পড়া ছেলেমেয়েদের অনার্স পাস করতে বেশ লেখাপড়া করতে হয়। চার পাঁচ বছর ধরে নিজের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকা এই ছেলেমেয়েরা হঠাৎ করে বিসিএস বা সরকারি চাকুরির পরীক্ষা দিতে সাধারণ জ্ঞান নিয়ে হাবুডুবু খেতে শুরু করে। তারা দেখে এতো কষ্ট করে এমবিবিএস, ইঞ্জিনিয়ারিং বা কৃষি বিজ্ঞানের নানা শেখা থেকে পাস করলেও চাকরির বাজারে তার আলাদা কদর নেই। সরকারি চাকুরিতে তাকে সব নতুন করে শুরু করতে হবে। সাধারণ জ্ঞান মানে তার কাছে নতুন যুদ্ধ।
আরও পড়ুন: দেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও নেই কোনো এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম
বহু কষ্টে সেই যুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে বিসিএস স্বাস্থ্য, কৃষি কিংবা প্রকৌশলী বা সরকারি কোন কলেজের শিক্ষকতা শুরুর কিছুদিন পরেই মানুষটা বুঝতে পারেন ছোটবেলায় তার চেয়ে পিছিয়ে থাকা ছেলেটি আজ তার বস হয়ে গেছে। কারণ তিনি প্রশাসনের কর্মকর্তা। সে দেখে ১০-২০ বছর চাকরি করেও তার একটা বসার জায়গা নেই, গাড়ি নেই, আর সদ্য যোগ দেয়া প্রশাসনের কর্মকর্তাটি বেশ ভালো আছেন।
অন্যদিকে বহু সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তাকে আমি বলতে শুনেছি, ইঞ্জিনিয়ার তো চোর। ডাক্তার এলাকায় থাকেন না। কিন্তু কেন ডাক্তার এলাকায় থাকেন না? তাদের কথাগুলো কি কেউ শুনেছেন? আপনারা কয়জন উপজেলায় ডাক্তারদের বসার জায়গাটা দেখেছেন? অনেক উজ্জলের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতালে ডাক্তারদের বসার জায়গা নেই। অনেক জায়গায় তারা যে পরিবেশে বসেন সেটি দেখলে আপনার মায়া হবে। একদিকে রোগী, আরেকদিকে ক্ষমতাশালীদের চাপ আর সবসময় আতঙ্ক, বিপরীতে সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। বিপরীতে প্রশাসন ক্যাডারের একজন এসিল্যান্ড বা ইউএনওর অফিস গাড়ি সুযোগ সুবিধা এসব দেখে আমাদের ডাক্তাররা ভাবে কেন তিনি ডাক্তার হলেন? এভাবে নানা বঞ্চনা দেখতে দেখতে ডাক্তার-শিক্ষকরা রোজ হতাশ হয়ে পড়েন। আর সিনিয়রদের হতাশা দেখে তরুণ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারটি চিন্তা করে তাকেও তাহলে সাধারণ ক্যাডারে যেতে হবে।
সিরাজগঞ্জের একজন কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল একবার। তিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কৃষি কর্মকর্তা। বহুকষ্টে মোটরসাইকেলে চড়ে আমার সঙ্গে একটা নিউজের বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলেন। নানা বিষয়ে তাঁর গবেষণা। ফসলের কীটপতঙ্গ নিয়ে তিনি কাজ করছেন। তার সেই কাজ দেখতে জাপান থেকে লোকজন এসেছে। তারা তাকে জাপানেও নিয়ে যেতে চায়। সেই কর্মকর্তা আফসোস করে জানালেন, চোখের সামনে কতো জুনিয়র এসে ইউএনও থেকে ডিসি হয়ে চলে গেছে। অথচ তিনি একই দশায়।
আফসোস করে ওই কর্মকর্তা বললেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে প্রথমবার কৃষি ক্যাডার পাবার পর দ্বিতীয়বার তিনি গিয়েছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের চাকরির জন্য। ভাইভা বোর্ডে ইয়াজউদ্দিন স্যার ছিলেন। স্যার তাকে বলেন, বাবা তুমি কৃষিতে পড়েছো। কৃষি ক্যাডারেই থাকো। কৃষকের জন্য কিছু করো। তোমার প্রশাসন ক্যাডারে আসার দরকার নেই। এরপর ভাইভা না নিয়েই তাকে পাঠিয়ে দেন। ওই কর্মকর্তা হতাশ কণ্ঠে বলেন, চাকরি করতে এসে তিনি প্রতিদিন বুঝেছেন, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বা প্রাপ্তিতে তিনি যে কারও চেয়ে পিছিয়ে।
এই যে ডাক্তার বা প্রকৌশলীরা আজ সাধারণ বা পররাষ্ট্র ক্যাডারে যাচ্ছেন কিন্তু কেন? আমি অনেক ডাক্তারকে বলতে শুনেছি, আমাদের আমলাতন্ত্রে ৭ম বিসিএসের একজন সিভিল সার্জনকে তার সন্তানের বয়সী ৩৩ বিসিএসের একজন ম্যাজিস্ট্রেট যখন 'সিএস সাহেব' বলে সম্বোধন করেন তখন তার প্রচণ্ড মন খারাপ হয়। ভীষণ অপমানে লাগে। আবার পরীক্ষার হলে সরকারি কলেজের সিনিয়ার এসিস্ট্যান্ট প্রফেসরকেও প্রশাসন ক্যাডারে সদ্য নাম লেখানো ম্যাজিস্ট্রেট যখন 'অমুক সাহেব' বলে সম্বোধন' করেন তিনি ভীষণ কষ্ট পান। কলেজ শিক্ষককে এদেশে স্যার বলতে পারেন না অনেকে, অথচ তাকে উল্টো অন্যদের স্যার বলতে হয়।
আরও পড়ুন: বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে গুচ্ছ পদ্ধতি বহাল থাকা জরুরি
আমার কথায় আমলাতন্ত্রের সাধারণ ক্যাডারের অনেকেই মন খারাপ করতে পারেন তবুও বলছি আমাদের দেশের রাজনীতি তো নষ্ট। আমরা অনেক কিছুর জন্যই তাই রাজনীতিবিদদের দায়ী করি। কিন্তু নোংরা রাজনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অনিয়ম দুর্নীতি আর পিছিয়ে থাকার একটা বড় কারণ এই কেরানি তন্ত্র যাকে আপনারা বলেন আমলাতন্ত্র।
গতানুগতিক পরীক্ষা পদ্ধতি আর জঘন্য মুখস্থ বিদ্যার বিসিএস আর কোটাতন্ত্র এই আমলাতন্ত্রের আরো ১২ টা বাজিয়েছে। বিসিএস দিয়ে মেধা তালিকার ৫০০ এর মধ্যে থেকেও চাকরি পাবে না, আবার কোটার কারণে দুই হাজারতম হয়েও চাকরির ব্যবস্থা আমাদের পুরো আমলাতন্ত্রের মান নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। পাশাপাশি সিস্টেমে সমস্যা, অনিয়ম, দুর্নীতি, দলবাজি তো আছেই।
আমি বলছি না প্রশাসনে সৎ মেধাবী লোক নেই, অবশ্যই আছে, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরীর মতো লোকের সংখ্যা তো খুব বেশি নয় যারা সবসময় সাধারণ মানুষের কথা ভাবেন। এর চেয়ে বরং আমাদের পুরো আমলাতন্ত্রটাই মানুষকে কষ্ট দেয়ার তন্ত্র। ব্রিটিশরা কেরানি বানানোর জন্য যে সিস্টেম এখানে চালু করেছিল আজও সেটি বহাল তবিয়তে টিকে আছে। ফলে সচিবদের কথা বাদ দিলাম এই দেশে অনেক সরকারি অফিসের নিম্নপদের কেরানিরও লাখ–কোটি টাকা আছে। কারণ ওই কেরানি তন্ত্র। আর এই কেরানি তন্ত্রের সবচেয়ে বড় বলি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার কিংবা শিক্ষকরা।
একবার ভেবে দেখেন, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারসহ বিজ্ঞানে বা ভালো কোন বিষয়ে পড়া তরুণেরা লেখাপড়া শেষে বুঝতে পারে, বাংলাদেশের চাকরির বাজারটা ভিন্ন। বুয়েটের একদল ছেলে তখন দেশ ছাড়ে। ডাক্তাররা বিকল্প খোঁজে। আর গনিত কিংবা পদার্থবিজ্ঞান পড়া ছেলেটা কিছু করতে না পেরে কেরানি কিংবা ব্যাংকের টাকা গোনার চাকরির জন্য লড়াইয়ে নামে কিংবা আমলা হতে চায়। এই হলো বিজ্ঞান পড়ার পরিণতি।
একবার ভেবে দেখেন, আপনি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার যাই হন না কেন, আমাদের আমলাতন্ত্রে প্রশাসন বা পুলিশের হাতেই সব ক্ষমতা। এই আমলাতন্ত্র এতোটাই শক্তিশালী যে আরবি থেকে পাস করা লোক এখানে কৃষি কিংবা স্বাস্থ্য সচিব বনে যান। আর কৃষি বিজ্ঞান বা ডাক্তারি পড়া ছেলেটা উপজেলায় অমর্যাদায় কাটায়। অথচ আমি কোনোভাবেই বুঝি না কৃষি ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা কেন কৃষি সচিব হবেন না? কেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের বদলে ইংরেজি পড়া ছেলেটিকেই স্বাস্থ্যসচিব হতে হবে। কেন একজন শিক্ষক শিক্ষাসচিব হবেন না? এসব হতাশার কারণেই ওই কিন্তু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররাও সাধারণ ক্যাডারে যেতে চায়।
অনেকেই বলতে পারেন, কোন সাবজেক্টে পড়েছে সরকারি চাকরিতে সেটা বিষয় নয়। চাকরি করতে করতে প্রশাসন ক্যাডারের লোকেরা যোগ্য হয়ে যান। হয়ত আপনারা ঠিক। তাহলে বলেন তো বিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এতো বিষয়ের এতো সিট রাখার দরকার কী? এর বদরে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করিয়ে যথাযথভাবে চাকুরির প্রশিক্ষণ দিলেই হয়।
ভেবে দেখেন সেনাবাহিনী যেমন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছেলেমেয়েদের চাকরি নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে অফিসার বানাচ্ছে আমরাও তাই করি। খামাকা পদার্থ গনিত ডাক্তারি পড়িয়ে লাভ কী? কারণ সেই তো অনার্স–মাস্টার্স পাস করে একটা চাকরি পাবার জন্য ছেলেমেয়েদের সেই ভয়ংকর লড়াইয়েই নামতে হবে। তার মধ্যে আবার সাধারণ ক্যাডারেই যেতে হবে।
আমি তো মনে করি বাংলাদেশের আজকের অগ্রগতির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান কৃষকের, কৃষি কর্মকর্তাদের। এরপর ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস শ্রমিক, স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী আর বিশাল বেসরকারি খাত। কিন্তু সেই খাতের মানুষগুলো কতটা সম্মান পান? হ্যাঁ, আমাদের আমলারাও এসব বোঝেন। অবসরে গিয়ে টেলিভিশন বা পত্রিকায় তারা নানা সংস্কারের কথা বলেন। আচ্ছা চাকরি জীবনে কী এসব বুদ্ধি আপনাদের মাথায় আসে না? অবসরে গিয়ে যে সচিব কোটা সংস্কারের কথা বলেন চাকরি জীবনে তিনি হয়ত তার জন্য কিছুই করেননি।
অবশ্য ৯০ এর পরে আমাদের আমলাতন্ত্র এখন এতোটাই বিভক্ত যে তারা সিদ্ধান্ত নেন দল চিনে। এখানে কর্মকর্তাদের মানের চেয়ে দলীয় যোগ্যতাই বেশি দেখা হয়। কাজেই তারা কতটা ভূমিকা রাখতে পারেন সেটাও প্রশ্ন।কেউ কেউ ভাবতে পারেন হঠাৎ করে কেন এতো কথা বলছি। সরকারি চাকরি করা এক প্রকৌশলী নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে হতাশ হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। সেটা দেখেই কথাগুলো মনে এলো। বেতন কাঠামো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক খুব ভালো উদাহরণ দিয়েছেন। তার মতে মাত্রাতিরিক্ত বেতন বাড়িয়ে এত বেশি অপমান কেউ করেনি।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কথা না হয় বাদ দিলাম তারা অনেক সুবিধা পান। কিন্তু এই দেশে যারা সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর সেই স্কুল শিক্ষকেরা কিন্তু সরকারি অফিসের অনেক পিয়নের চেয়ে কম বেতন পান। তাহলে কেন একজন মানুষ শিক্ষক হবে? ডাক্তার যখন তার পেশায় নানা সমস্যা তিনি কেন ডাক্তার থাকবেন? ফলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-শিক্ষক সব বাদ দিয়ে দেশের তরুণরা সবাই একদিন সচিব হতে চাইবেন সেটাই তো স্বাভাবিক।
আমি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এই দেশের তরুণদের একটা বড় অংশই তাদের মেধা–যোগ্যতা শেষ করে ফেলছে একটা সরকারি চাকরির পেছনে। সবাই এখন প্রশাসন কাডারে যোগ দেয়ার স্বপ্ন দেখছে। আর মেধাবীদের আরেকটা বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বিশেষ করে বিজ্ঞানে পড়া। আর যারা থাকছে তারা বিসিএস প্রকৌশলী, কৃষি বা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হয়ে আজীবন ছোট হয়ে থাকছে। বাধ্য হয়ে এখন তারা সাধারণ ক্যাডার বেছে নিচ্ছে।
অনেকে অনেক কিছু বলতে পারেন। তর্ক বিতর্ক করতে পারেন। আমি কাউকে অসম্মান করছি না। কাউকে কষ্ট দিতে চাচ্ছি না। বরং বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হোক। সংস্কার হোন। কারণ এই দেশের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা সবাই আমাদেরই ভাইবোন। সমস্যা সমাধান করতে হলে সব পেশাকে সমান মর্যাদা দিতে হবে। একটা দেশকে আগাতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক করতে হয়। কারিগরি শিক্ষায় জোর দিতে হয়।
সমস্যা হলো আমাদের দেশে কেউ বিষয়গুলো বুঝতে চায় না। যে ছেলেটা পুলিশ ক্যাডারে চলে যায় তার কাছে মনে হয় পুলিশই সব। প্রশাসনের সমস্যা তিনি বুঝতে চান না। যিনি প্রশাসনে যান তিনি পুলিশকে মানুষ মনে করেন না। শিক্ষক-ডাক্তারদের তো বসার জায়গাও থাকে না। বাকিরা যখন দেখে সদ্য যোগ দেয়া ছেলেটা গাড়ি হাঁকাচ্ছে আর তিনি দশবছরেও বসার জায়গা পাচ্ছেন না তখন কিন্তু তার মধ্যে হতাশা বাড়ে। ফলে সবাই এখন আমলা হতে চায়।
আসলে এই দেশে শিক্ষা, কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, ডাক এমন সব ক্যাডার নামে থাকলেও বাস্তবে তারা এতো বঞ্চিত যে হতাশায় ভোগেন। আমার মনে হয় এতো ক্যাডার না রেখে পাশের দেশ ভারতের মতো শুধু প্রশাসন, পুলিশ, ফরেন এই তিনটা ক্যাডার রাখা উচিত। বাকিরা সব টেকনিকাল লোক থাকবে।
বিষয়গুলো নিয়ে সবাই একটু ভাবেন। মনে রাখবেন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়াররা যদি তাদের পেশায় হতাশ হয়ে সবাই বিসিএস দেয়া শুরু করে তাহলে কিন্তু সাধারণ বিষয়ে লেখাপড়া ছেলে মেয়েদের বিসিএসে চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
আরেকটা কথা। বিসিএসের এই উন্মাদনা নিয়েও ভাবেন। সবাইকে কেন বিসিএস দিতে হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের লাইব্রেরীগুলোতে যান দেখবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার বদলে প্রায় সবাই সাধারণ জ্ঞান মুখস্থ করছে বা চাকরির পড়া পড়ছে প্রথম বর্ষ থেকেই। কারণ এই দেশে এখানে সবার স্বপ্ন প্রশাসন বা পুলিশে গিয়ে আমলা হওয়া।
ভাবতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে কী ডাক্তার কী প্রকৌশলী কি সাধারণ কী অসাধারণ সবাই প্রশাসন বা পুলিশ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। এই সমস্যার সমাধান না হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাই পুরোপুরি যে ধ্বংস হবে তাই নয়, আমাদের তারুণ্যের সব স্বপ্ন হারিয়ে যাবে। কেউ তখন কবি, গায়ক, সাংবাদিক, ডাক্তার না, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা শিক্ষক হতে চাইবে না। শুধু প্রশাসন আর পুলিশে যেতে চাইবে। তাতে বিসিএসতন্ত্রের জয় হলেও বহু সম্ভাবনা ধ্বংস হবে, পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশ! কারণ একটা দেশকে আগাতে হলে সবাইকে লাগবে। সবাইকে।
এই স্ট্যাটাসটা নয় বছর আগে আজকের দিনে লেখা। আজকে এই দেশের ভূতত্ত্ব ও খনিজ সম্পদ গবেষণার প্রধান কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। ভবনের চেহারা ও সেখানকার দুরবস্থা দেখে শিক্ষক চিকিৎসক নিয়োগের নানা আলাপ শুনলাম। আসলে নয় বছরে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। মানুষে মানুষে আন্ত ক্যাডার বৈষম্য আরো বেড়েছে। শেষের কথাটাই তাই আবার বলি, একটা দেশকে আগাতে সবাইকে লাগবে। এখানে বৈষম্য দূর করে সবার জন্য সমান মর্যাদা ঠিক করা জরুরি। নয়তো পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। আশা করছি আমাদের নীতি নির্ধারকদের বোধোদয় হবে!
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক