২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪০

৩৪ বছরের সাফল্যের গল্প: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ও আগামীর স্বপ্ন

ড. মোর্ত্তূজা আহমেদ  © টিডিসি সম্পাদিত

১৯৯১ সালের ২৫ নভেম্বর খুলনা শহরের দক্ষিণাঞ্চলে এক স্বপ্নপুরণের মতো প্রতিষ্ঠিত হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন থেকেই এটি বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে যেমন এটি খুলনা অঞ্চলের মানুষের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করেছে, অন্যদিকে দেশের বৃহত্তর শিক্ষাব্যবস্থাতেও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে।

আজ থেকে ৩৪ বছর আগে যখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়, তখন এটি ছিল একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা দক্ষিণ বাংলার শিক্ষার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে—এমন আশাবাদ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯১ সালের দিকে, খুলনা শহর ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা খুবই সীমিত ছিল। কিন্তু, সময়ের সাথে সাথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সেই শূন্যতা পূর্ণ করেছে এবং এর অনন্য শিক্ষা ব্যবস্থা, গবেষণা কার্যক্রম এবং সমৃদ্ধ ক্যাম্পাসের মাধ্যমে আঞ্চলিক এবং জাতীয় ক্ষেত্রে শিক্ষা ও গবেষণায় নতুন উদাহরণ স্থাপন করেছে।

এই ৩৪ বছরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু যে শিক্ষার মান উন্নয়ন করেছে তা নয়, পাশাপাশি এটি সমাজে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব এবং আইডিয়াগুলোর জন্ম দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার বিপ্লব যেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছে প্রমাণ করেছে যে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একাডেমিক চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। শিক্ষার্থীদের সজাগতা, সচেতনতা এবং তাদের নেতৃত্বের দক্ষতা আজকের সমাজের জন্য একটি আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য একেবারেই আলাদা, যেখানে শিক্ষার মান, পরিবেশ এবং দর্শন সব মিলিয়ে একটি নতুন পথ তৈরি করেছে। এককথায়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেই জায়গা, যেখানে মেধা, স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতির সেতু গড়ে ওঠে।

প্রথমেই উল্লেখযোগ্য যে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় তার রাজনীতি-নিরপেক্ষ পরিবেশের জন্য পরিচিত। এখানে রাজনৈতিক দলের তৎপরতা নেই, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে সহায়তা করে। এভাবেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি নিবেদিত থাকতে এবং মেধার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে উৎসাহিত করে। যেমন, ছাত্র সংসদের নির্বাচন না হওয়া কিংবা রাজনৈতিক উত্তেজনা থেকে দূরে থাকা এটি শিক্ষার্থীদের একত্রিত হতে এবং নিজেদের শিক্ষাগত লক্ষ্য নিয়ে মনোযোগী হতে সাহায্য করে।

এছাড়া, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক অত্যন্ত সুসম্পর্কিত ও সম্মানজনক। শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের যত্ন এ দুটি বিষয় একে অপরকে পরিপূরক করে। উদাহরণস্বরূপ, এখানকার শিক্ষকেরা শুধু পাঠদানে নয়, বরং শিক্ষার্থীদের পেশাগত দক্ষতা এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও সহায়তা প্রদান করে থাকেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের কাছ থেকে শুধুমাত্র পাঠ্যবিষয় নয়, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পাঠও শিখে থাকে। এভাবে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলো একটি শক্তিশালী গাথুনির মতো একে অপরের সাথে মিলে, একটি সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে, যা শুধু শিক্ষার্থী নয়, পুরো সমাজকেই উপকৃত করে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গবেষণা ও উদ্ভাবনে অনন্য অবদান রেখে আসছে। এটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি জ্ঞান ও উদ্ভাবনার কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যেখানে গবেষকরা নিজেদের চিন্তা ও সৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: ৩৫ বছরে পদার্পন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের

একটি অন্যতম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাকে, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই বিভাগে বিশেষজ্ঞ গবেষকরা সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চলের পরিবেশগত পরিবর্তন, স্যলিনিটি (লবণাক্ততা) বৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নানা ধরনের নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা উদ্ভাবন করেছেন। যেমন, তারা সল্পমূল্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য 'আধুনিক সেচ ব্যবস্থাপনা' নিয়ে গবেষণা করেছে, যা বাংলাদেশের কৃষি খাতে বিপ্লব আনতে সক্ষম।

এছাড়াও ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার বিপ্লব খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের সাহসী নেতৃত্বের মাধ্যমে এ অঞ্চলে একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী ছিল না, বরং তারা ছিল এই বিপ্লবের প্রাণ। তাদের দৃঢ় মানসিকতা এবং সংগঠিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, তারা ছাত্র ও সাধারণ জনতার মধ্যে একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, যা আন্দোলনকে আরো বেগবান করে। এই ঐক্য গড়ে ওঠার পেছনে ছিল শিক্ষার্থীদের একত্রিত শক্তি এবং দেশপ্রেমের উৎসাহ। তারা জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়িয়ে, অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে একসঙ্গে লড়াই করে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভূমিকা ছিল এক নব্য সূর্যের মতো, যা অন্যদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ বছরের যাত্রা আমাদের শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তৃত আকাশের দিকে নির্দেশ করে, তবে আসল গন্তব্য এখনো অনেক দূরে। ভবিষ্যতে এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারে। এর প্রস্তাবিত উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, যা বিশ্বমানের গবেষণা, শিক্ষার পরিবেশ এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ, নতুন বিভাগ ও কোর্স চালু করা, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষার প্রতিটি স্তরে বৈশ্বিক মান অর্জন করতে সক্ষম হবে।

বর্তমান সময়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে সার্থক করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রয়োজন, যার মধ্যে অন্যতম হলো সম্প্রসারণের জন্য জমি অধিগ্রহণ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণে জমি অধিগ্রহণ একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বহু আইনি, সামাজিক এবং প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। স্থানীয় জনগণের আপত্তি এবং সরকারি বিধি-নিষেধ প্রক্রিয়াটি জটিল করে তুলছে। তবে, সঠিক পরিকল্পনা, অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মাধ্যমে এবং স্থানীয় কমিউনিটির সাথে সমন্বয় করে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ যদি সুবিচারের সাথে জমি অধিগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে, তবে এটি অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. হারুনর রশিদ খান এবং ট্রেজারার অধ্যাপক মো. নূরুন্নবী এর কার্যকর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটির গতি ও উন্নতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। উপাচার্যের নেতৃত্বে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন দ্রুত আগাচ্ছে, যেখানে আধুনিক ল্যাবরেটরি এবং নতুন ভবন নির্মাণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন পরিবেশ উন্নত করা হচ্ছে। গবেষণা ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যেমন আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগিতা বাড়ানো এবং গবেষণার মান উন্নয়ন। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে নতুন প্রশিক্ষণ ও কোর্স চালু করা হয়েছে, যা তাদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রস্তুত করছে। এছাড়া, সামাজিক দায়বদ্ধতায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সামাজিক কর্মকাণ্ডের প্রতি উৎসাহিত করা হচ্ছে।

৩৪ বছরের পথচলায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। রাজনীতি-নিরপেক্ষ পরিবেশে মেধাবৃত্তিক শিক্ষার প্রসার, গবেষণায় অসাধারণ সাফল্য এবং ছাত্রদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন—সবকিছু মিলিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি দেশের উচ্চশিক্ষায় একটি মাইলফলক স্থাপন করেছে।

তবে, এই অর্জনগুলোর সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ, যেমন অবকাঠামোগত উন্নয়ন বিশেষ করে ছাত্র ছাত্রীদের হল নির্মাণ, জমি অধিগ্রহণ, এবং স্থানীয় ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আরও কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, দৃঢ় নেতৃত্ব, এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব।

ভবিষ্যতের পথে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমাজের প্রগতিতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। ২০২৪ সালের ছাত্র জনতার বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, তারা কেবল জ্ঞান অর্জনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জাতির সামনে আশার আলো হয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী দিনগুলো আরও সমৃদ্ধ ও গৌরবময় হোক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ৩৪ বছরের সাফল্যের এই যাত্রায়, যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সাহস নিয়ে এগিয়ে চলুক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। শুভ জন্মদিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।