বিশুদ্ধ সামরিক-তৌহিদী রাজনৈতিক চিন্তাবিদ্যালয়সমূহের রাষ্ট্রচিন্তায় সীমাবদ্ধতা
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক ও তৌহিদী রাজনৈতিক চিন্তাবিদ্যালয়গুলো তৎপর রয়েছে। সামরিক চিন্তাবিদ্যালয় হলো অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা এবং তাঁদের সমর্থক সামরিক কর্মকর্তা ও অনুসারী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত চিন্তাবিদ্যালয়। আর ওলামা-মাশায়েখ শ্রেণীর নেতৃত্বে তৌহিদী জনতার সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত চিন্তাবিদ্যালয় হলো তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়। এই দু’প্রকার চিন্তাবিদ্যালয়েরই দেশজুড়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত রয়েছে। এই চিন্তাবিদ্যালয়গুলোর রাষ্ট্রচিন্তা প্রসূত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা গত পাঁচ দশকে কয়েকবার এ দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তন ঘটেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগস্ট ও ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই আগস্ট সংঘটিত রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। এই উভয় রাজনৈতিক চিন্তাবিদ্যালয়ের সদস্যগণই মনে করেন যে, তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তা অতি বিশুদ্ধ। কিন্তু এই বিশুদ্ধ রাষ্ট্রচিন্তা দ্বারা জনগণকে অধিকার আন্দোলনে উদ্দীপ্ত করে রাষ্ট্রযন্ত্রে ক্ষমতার পট পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হলেও, অন্তিমে বিশুদ্ধ রাষ্ট্রচিন্তা দ্বারা রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করা যায়নি বা যাচ্ছে না। কারণ, অধিকার আন্দোলনের রাষ্ট্রচিন্তা আর রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রচিন্তা এক নয়।
বস্তুত: রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা সহায়ক রাজনীতি খুবই জটিল। কারণ রাজনীতি একক কোনও নীতি নয়। বরং রাজনীতি হলো শিক্ষানীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, সংস্কৃতি নীতি ও লিঙ্গসাম্য নীতি ইত্যাদি নানান নীতির সাথে সম্পৃক্ত নীতি বিশেষ। এই একই কারণে সকল নীতিকে সামগ্রিকভাবে সংস্কার না করে, কেবলমাত্র রাজনীতির সংস্কার করা সম্ভব নয়। তবে নীতি যেখানে আছে, সেখানে দুর্নীতিও আছে। পৃথিবীতে এমন কোনও রাষ্ট্র নাই, যেখানে দুর্নীতি নাই। তবে দুর্নীতি যুক্ত রাষ্ট্র কোনও দেশের জনগণেরই কাম্য নয়। যদিও দুর্নীতি কাম্য নয়, তবুও দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্র থেকে জনগণ তাদের প্রাপ্য সেবা ও সুযোগ-সুবিধা পায় না। সে জন্য রাষ্ট্রে অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বদাই জনগণের এক প্রকার অসন্তোষ বিরাজ করে। বাংলাদেশেও গত পাঁচ দশক ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ব্যাপক দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিল এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামরিক চিন্তাবিদ্যালয় ও তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয় এই উভয় চিন্তাবিদ্যালয়ই সর্বদাই সোচ্চার হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, উক্ত দু’টি চিন্তাবিদ্যালয়েরই রয়েছে নিজ নিজ রাষ্ট্র দর্শন। যে কারণে সামরিক চিন্তাবিদ্যালয়গুলো বিশুদ্ধ প্রশাসনবাদ এবং তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়গুলো ইসলামবাদকে পুঁজি করে সর্বদাই আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের রাষ্ট্রচিন্তা নিয়ে মশগুল রয়েছে। কিন্তু তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তা খুবই সরল। সামরিক চিন্তাবিদ্যালয়স্থ রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ মনে করেন যে, তাঁদের রয়েছে মেধা, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও দেশাত্মবোধ এবং তাঁরা তাঁদের সেই সমস্ত গুণ দ্বারা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানসমূহ সঠিকভাবে পরিচালনা করলে রাষ্ট্র সুচাররূপে পরিচালিত হবে। ফলে দেশে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হবে। অন্যদিকে তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়স্থ রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ মনে করেন যে, তাঁদের রয়েছে সততা, খোদাভীতি এবং কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক জ্ঞান। তাঁদের বিশ্বাস যে, তাঁরা তাঁদের সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্য দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করলে দেশে ইসলামী সমাজব্যবস্থা কায়েম হবে। ফলে দেশ দুর্নীতি ও অপশাসন মুক্ত শান্তিময় রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
তবে, উক্ত উভয় চিন্তাবিদ্যালয়ের রাষ্ট্রচিন্তায়ই কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রাষ্ট্রচিন্তায় এই সীমাবদ্ধতা মূলত রাষ্ট্রের সংকীর্ণ সংজ্ঞায়ন থেকে উৎসারিত হয়েছে। কারণ রাজনীতি বিজ্ঞানে রাষ্ট্রের সংজ্ঞা সামরিক-তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়গুলো কর্তৃক কল্পিত সংজ্ঞার মতো এতো সরল নয়। রাজনীতি বিজ্ঞানে রাষ্ট্র হলো কেন্দ্র থেকে প্রত্যন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরবিন্যস্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, আধা-রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় বিশেষ। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিরই ভৌত ও কোমল উপরিকাঠামো রয়েছে। তবে অনেক অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কোমল উপরিকাঠামো থাকলেও, ভৌত উপরিকাঠামো থাকে না। কোমল উপরিকাঠামো হলো প্রতিষ্ঠান পরিচালনার আইনকানুন, নিয়ম, নীতি ও রেওয়াজ ইত্যাদি। অন্যভাবে দেখতে গেলে রাষ্ট্র হল শাসন ও শোষণের আপাত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বিশেষ, যেখানে সীমিত সম্পদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সদা বিতর্ক, দ্বন্দ্ব ও মারামারি অব্যাহত থাকে। আর গণতন্ত্র হলো প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে মিটানোর ব্যবস্থা বিশেষ, যেখানে ক্ষমতায় আরোহণের একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ক্ষমতা পরিচালনার একটি জবাবদিহিতা থাকে। তবে আদতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক গোষ্ঠী সম্পদ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বণ্টন ব্যবস্থার ওপর অশেষ ক্ষমতা লাভে করে। এই ক্ষমতা ব্যবহার করে তারা তাঁদের কৃত অনিয়মগুলো থেকে অব্যাহতি লাভ করে থাকে। যে কারণে বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতো বৈশ্বিক দক্ষিণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে দুর্নীতি অন্যতম উপসর্গ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। বৈশ্বিক দক্ষিণের রাষ্ট্রসমূহে দুর্নীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক গোষ্ঠী বিত্তবান হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও জার্মানীর মতো রাষ্ট্রসমূহে রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনরা প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতি না করেও, রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার করে বিত্তশালী হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও জার্মানীর পার্থক্য হলো এই যে, সে সব দেশে ক্ষমতা খাটিয়ে অর্থবিত্তের মালিক রাজনীতিবিদরা নিজ দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে না।
কিন্তু সামরিক-তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়গুলোর রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণের রাষ্ট্রচিন্তায় উক্ত রাজনৈতিক উপসর্গগুলো অন্তর্ভুক্ত নয়। যে কারণে বলা যায় যে, তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তা সীমাবদ্ধতা দোষে দুষ্ট। কেননা, সামরিক চিন্তাবিদ্যালয় মনে করে যে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানসমূহ সামরিক মেধা দ্বারা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা হলে, সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানসমূহ সামরিক মেধা দ্বারা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা গেলেও, সমস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা এই সামরিক মেধা, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও দেশাত্মবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়ের রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণের রাষ্টচিন্তাও ত্রুটিযুক্ত। কেনোনা তৌহিদী রাষ্ট্রচিন্তা অনুযায়ী সততা, খোদাভীতি এবং কোরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান সম্পন্ন ওলামা-মাশায়েখগণ রাষ্ট্র পরিচালনা করলে, দেশে দুর্নীতিমুক্ত ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম হবে। ফলে মানুষ সমাজে সুখে-শান্তিতে বাস করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, মানুষ প্রবৃত্তির দাস। সে একই সাথে সৎ ও অসৎ। কোনও মানুষ একটানা সৎ থাকতে পারে না। সে যে কোনও সময় অসৎ চিন্তা ও অসৎ কর্মে লিপ্ত হতে পারে। কাজেই ধর্মপ্রাণ মানুষ মাত্রই সৎ হবে, একথা সঠিক নয়। কাজেই সৎ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ হলে সৎভাবে রাষ্ট্র চালিয়ে সুখ-শান্তির আদর্শ রাষ্ট্র উপহার দিতে পারবে এমন কোনও কথা নেই।
সার্বিকভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয়। যারা প্রতিষ্ঠান চালানোর দায়িত্ব নেয়, তাঁরা সৎ এবং একই সাধে অসৎ মানুষ। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের ধারক, বাহক ও পরিচালকরাও আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। কাজেই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া বিশেষ। এই প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের ধারক, বাহক, ও পরিচালকগণের রাগ-বিরাগ ও সৎ-অসৎ চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তা সত্ত্বেও আলোচিত এই চিন্তাবিদ্যালগুলোর অতি সরল চিন্তা জনমানুষের মনে আশার সঞ্চার করে। কিন্তু বিশুদ্ধ এই চিন্তাবিদ্যালয়গুলোর রাষ্ট্রচিন্তা রাজনীতি বিজ্ঞানের দর্শন, নীতি ও সূত্র পরিপন্থী। যে কারণে তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তাগুলো দেশী-বিদেশী স্বার্থান্বেষী মহলের দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র করার ক্ষেত্র প্রস্তুতে সহায়ক হয়। ফলে এই চিন্তাবিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ঝুঁকির মুখে পড়ে এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াধীনে নিপতিত হয়। উল্লেখ্য যেচ, রাষ্ট্রব্যবস্থা ঝুঁকির মুখে পতিতে হলে, বহি:শত্রু দেশে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
সবশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রযোজিত রাজনীতির লক্ষ্য হল ক্ষমতার বিন্যাস ও সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কাজেই ক্ষমতার রাজনীতিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিকে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয়, আধারাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় নানা পক্ষকে বুঝিয়ে এবং ভয় বা লোভ দেখিয়ে সমন্বয় করে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করতে হয়। অধিকন্তু এই রাজনৈতিক শক্তিকে বহি:শত্রুর নানান কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা চক্রান্ত মোকাবিলা করে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু বিশুদ্ধ সামরিক-তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়গুলোর রাষ্ট্রচিন্তায় রাজনীতির এই জটিল অনুষঙ্গগুলো অন্তর্ভুক্ত নয়। যে কারণে বলা যায় যে, চিন্তাবিদ্যালয়সমূহের জনগণের অধিকার আন্দোলন কেন্দ্রিক এই যে রাষ্ট্রচিন্তা তা মূলত খণ্ডিত রাষ্ট্রচিন্তা বিশেষ। যে কারণে বিশুদ্ধ সামরিক-তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়সমূহের এই খণ্ডিত রাষ্ট্রচিন্তা দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়। কাজেই বিশুদ্ধ সামরিক-তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালগুলো ওপরে আলোচিত রাজনীতি বিজ্ঞানের উক্ত দর্শন, তত্ত্ব ও সূত্রসমূহ যোগ করে রাষ্ট্রচিন্তায় তাঁদের সীমাবদ্ধতা ঘুচিয়ে, তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়