জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার কোন আইনে?
জুলাই-আগস্টে সংগঠিত গণহত্যায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মামলা দায়ের করতে পারবে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান প্রসিকিউটর (কৌঁসুলি) করিম এ এ খান। ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদরদপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে জুলাই-আগস্ট গণহত্যা নিয়ে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান (বাসস, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (বাংলাদেশ) (আইসিটি) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে (দৈনিক প্রথম আলো ,১৪ আগস্ট ২০২৪)। এ উপলক্ষ্যে আইনটি সংশোধনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও (বাংলাদেশ) (আইসিটি) শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আইসিসি-তে মামলা করা। আইসিসি এই ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচারের জন্য সবচেয়ে কার্যকর আন্তর্জাতিক সংস্থা।
এখন প্রশ্ন হলো জুলাই -আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার বিচার কোন আইনে করবে সরকার? নতুন সরকার ইতিমধ্যে দুই মাস অতিবাহিত করেছে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয় নি। আইসিটিতে এখনো বিচারক নিয়োগ দেয়নি। গণহারে কেবল মামলা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫ আগস্টের মতো ঘটনা আর ঘটেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে জুলাই-আগস্টের মত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও আর ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে গত জুলাই-অগাস্টে কোটা সংস্কার ও পরবর্তীতে সরকার পতন আন্দোলনের সময়। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ তাদের চোখ হারিয়েছেন (দৈনিক যুগান্তর, ২৯ আগস্ট ২০২৪)।
এছাড়া ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, এবং সাধারণ মানুষ। আর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ এসেছিল দেশের সর্বোচ্চ স্থান থেকে। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে এসব হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। শেখ হাসিনা সরকারের উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও দলীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে এসব হত্যাকাণ্ড চালান।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে জুলাই হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত শুরু
তীব্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ০৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। বর্তমানে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে সংগঠিত অপরাধ বিশেষ করে জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় সংগঠিত অপরাধ রোম চুক্তির ০৫ এবং ০৭ অনুচ্ছেদের আওতায় পড়ে। তাই শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধের তদন্ত, বিচার এবং ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নেদারল্যান্ডের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিচারিক আদালত।
আইসিসি সাধারণত গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ; যুদ্ধাপরাধ; এবং আগ্রাসনের (রোম চুক্তি, অনুচ্ছেদ ৫) বিচার করে থাকে। আইসিসির সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত অপরাধকে গণহত্যা বলা কঠিন। জুলাই-আগস্টে সংগঠিত অপরাধ রোম চুক্তির ০৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলা বেশি যৌক্তিক।
রোম চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক অপরাধ, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আইসিসি-তে মামলা করা। আইসিসি এই ধরনের অপরাধের তদন্ত ও বিচারের জন্য সবচেয়ে কার্যকর আন্তর্জাতিক সংস্থা।
সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আইসিসিতে অভিযোগ দায়ের করলে আইসিসির প্রসিকিউটর অফিসআইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার থেকে অনুমতি না নিয়েই তদন্ত শুরু করতে পারবে। এছাড়া আইসিসিতে জুলাই-আগস্টে সংগঠিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য মামলা করলে বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে।
বাংলাদেশের আদালত অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে বিচার করতে পারে। এটি আরেকটি সমস্যা তৈরি করতে পারে। অপরাধীর অনুপস্থিতিতে বিচার করা হলে এবং শাস্তি দেয়া হলে, অপরাধী বিদেশে থাকলে তাকে ফিরিয়ে আনতে বেশ জটিলতায় পড়তে হবে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রচলিত ফৌজদারি আদালত বা আইসিটি-তে হলে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠতে পারে যেমন অতীতে হয়েছে।
এছাড়া ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগ সমর্থিত সরকারে ক্ষমতায় আসলে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারে বা অপরাধীদের ক্ষমা করে দিতে পারে। আইসিসিতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলেও বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা সম্ভব হবে না।তাছাড়া ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংগঠিত অপরাধের সাথে জড়িত অপরাধীরা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশে পালিয়েছে গেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও ভারতে পালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশে তাদের শাস্তি হলেও বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করা কঠিন হবে। অন্যদিকে, বর্তমানে আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র ১২৪ টি। আইসিসি অভিযুক্ত/অপরাধীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে সদস্য রাষ্ট্রগুলো অপরাধীকে আইসিসির কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য থাকবে।
এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা তৈরি করতে পারে যদি তারা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন দেশে স্থায়ী হয়ে থাকে। কেননা বর্তমানে, ১১২টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ২৩ অক্টোবর ২০১৮)। ফলে ফৌজদারি আদালত বা আইসিটি মৃত্যুদণ্ড দিলে অপরাধী বিদেশে আশ্রয় নিয়ে থাকলে তাকে ফিরিয়ে এনে শাস্তি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশের আইন মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন না করলে, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যাবর্তন চুক্তি থাকলেও সে দেশ অপরাধীকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে না। আইসিসির ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। কারণ আইসিসিতে মৃত্যুদণ্ড নেই। মামলার গুরুত্ব বিবেচনায় আইসিসি ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে পারে।
বাংলাদেশের আদালত অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে বিচার করতে পারে। এটি আরেকটি সমস্যা তৈরি করতে পারে। অপরাধীর অনুপস্থিতিতে বিচার করা হলে এবং শাস্তি দেয়া হলে, অপরাধী বিদেশে থাকলে তাকে ফিরিয়ে আনতে বেশ জটিলতায় পড়তে হবে।
আইসিসির যেকোনো ব্যক্তির বিচার করতে পারে, অপরাধী যে পদেই থাকুক না কেন। আইসিসি রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারে ও বিচার করতে পারে। দেশীয় আদালত এবং ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে বিচার করা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
বাংলাদেশ আইসিসিতে মামলা করলে বিচার প্রক্রিয়া যেমন স্বচ্ছ হবে এবং তেমনি বিপুল আর্থিক খরচ থেকে বাংলাদেশ রক্ষা পাবে। সেই সঞ্চিত অর্থ দেশের পুনর্গঠনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আইসিসিই একমাত্র বিচারিক আদালত যা ভিকটিম এবং অভিযুক্ত উভয়ের জন্য ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে বিপুল সংখ্যক মানুষের হত্যার বিচার নিশ্চিত করা। এটাও নিশ্চিত করতে হবে অভিযুক্তরা যাতে ন্যায় বিচার পান। ন্যায় বিচার আর শান্তি এক বিষয় নয়। অতীতে আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের সাজা দেয়া হয়েছে কেবল মাত্র। আদালতকে ব্যবহার করে ফাঁসিতেও ঝুলানো হয়েছে অনেককে। যে বিচার ছিল ত্রুটিপূর্ণ। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সবার জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দেশের ভেতরে করলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে কাজ শুরু করতে হবে দ্রুততার সাথে। আর আইসিসিতে মামলা দায়ের করতে চাইলে তাতেও কালক্ষেপণ করা যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কি আইসিসিতে মামলা দায়ের করবে জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে নাকি আইসিসিতেই বিচার করবে? বিষয়টি দ্রুত ঘোষণা করা উচিত।
আইসিটিতে বিচার করলে বিচারক নিয়োগসহ আইসিটি পুনর্গঠন করতে হবে দ্রুত। কালক্ষেপণ করলে তথ্য-প্রমাণ যেমন নষ্ট হবে তেমনি শহীদদের প্রতি অবিচার করা হবে।
লেখক: ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক আইনের গবেষক।