বদলে যাওয়া ছাত্র রাজনীতি: জনসমর্থন থেকে জনঅসন্তোষে
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একতরফা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্ররাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস চাই’ দাবিটি জোড়ালোভাবে পেশ করেছেন। যে দেশে ছাত্র রাজনীতির রয়েছে এক গৌরবময় ইতিহাস। সেখানে কেন আজ সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক ও অভিভাবকরা সবাই একটি ছাত্ররাজনীতি মুক্ত শিক্ষাঙ্গনের দাবি তুলছেন তা আবারো আলোচনার দাবি রাখে।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক অধ্যায়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘যুগান্তর দল’, ‘কংগ্রেস ছাত্র ফেডারেশন’ ইত্যাদি ছাত্র সংগঠন গড়ে উঠে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্ররা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন: ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি চাই না: চবিতে হাসনাত আবদুল্লাহ
১৯৫২ সালে ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনের মিছিলে নামলে পুলিশের গুলিতে রফিক, সালাম, বরকতসহ কয়েকজন নিহত হলে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৪ সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার অত্যন্ত প্রতিকূল ও বৈষম্যমূলক একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলে ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সরকার তা স্থগিত করতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্ররা অসহযোগ আন্দোলন ও সশস্ত্র প্রতিরোধের নেতৃত্ব দেয়। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীতে যোগ দিয়ে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় করে। এ সময়ের ছাত্র রাজনীতি মূলত জনগণের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করার প্রতীক হিসেবে কাজ করেছে। তাদের লক্ষ্যই ছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণ। যে কারনে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছাত্ররাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা ছিল।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির চরিত্র পরিবর্তিত হয়। স্বাধীনতাপূর্ব যুগের ছাত্র সংগঠনগুলির আদর্শ ও কার্যক্রম পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, স্বাধীনতার পর ছাত্র সংগঠনগুলো সরকারি দলের অনুসারী হয়ে ওঠে এবং তাদের কার্যকলাপ স্বাধীনতাপূর্ব সামরিক জান্তার সৃষ্ট ছাত্র সংগঠনের মত হয়ে যায়। এতে ছাত্ররাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ও চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে যা ছাত্ররাজনীতির ক্রমাধঃপতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক দলবিধি জারির মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির আওতায় আনা হয়। যা ছাত্র রাজনীতির বিপথগামী ধারার সূচনা করে বলে অনেকেই মনে করেন। এই পরিবর্তনের ফলে ছাত্ররাজনীতি এখন রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতা ধরে রাখার কিংবা গদিচ্যুত করার এজেন্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের অপরিপক্ব সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ ছাত্র রাজনীতি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা প্রায়ই অছাত্র এবং মেধা বা দেশপ্রেমের পরিবর্তে পেশি ও অস্ত্রশক্তিকে প্রাধান্য দেয়। এর ফলে তারা জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের চোখে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও নিপীড়ক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। পাকিস্তান আমলে জনসমর্থনহীন সরকার কিছু গুন্ডা পান্ডা দিয়ে ছাত্রসংগঠন এনএসএফ (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন) তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্তানি করত। কিন্তু সেটিরও একটি সীমা ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ছাত্ররাজনীতি তার থেকেও ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ছাত্ররাজনীতি যত প্রকট আকার ধারণ করেছে তত মান কমেছে পড়াশোনার। যেখানে ছাত্রদের রাজনীতির ফলে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা, আবাসন ব্যবস্থা এবং অন্যান্য দরকারি বিষয়ে উন্নতির কথা ছিল সেখানে হয়েছে ঠিক উল্টো। ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার ১৩ শতাংশের জন্য ক্যাম্পাস সহিংসতাই দায়ী। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বস্তির জায়গা থেকে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি ছাত্র জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পদত্যাগের ১ দফা দাবির আগে ঘোষিত ৯ দফার মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল ক্যাম্পাসে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। বলা যায় সহিংস কার্যক্রম, দলীয় লেজুরবৃত্তি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হল দখল, নিপীড়ন ও নির্যাতন এসবই ছাত্র রাজনীতির প্রতি জন অসন্তোষ তৈরি করেছে। এখন ছাত্র রাজনীতি ও আন্দোলনের ভূমিকা এবং তার গতিপথ নিয়ে নতুন ভাবনা ও আলোচনা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত হয় এবং দেশের উন্নয়নে তারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।