উপাচার্যদের পদত্যাগের হিড়িক কেন?
সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকাগুলিতে ‘উপাচার্যের পদত্যাগ চাই’ অথবা ‘উপাচার্য পদত্যাগ করলেন’ শিরোনামের খবরগুলো ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের যে ঢেউ শুরু হয়েছিল, তা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদেরকেও স্পর্শ করেছে। শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক দাবিগুলো ছিল সরকারের প্রতি, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে রূপ নেয়। তবে লক্ষণীয় যে, শিক্ষার্থীরা তাঁদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সময় কখনও কোনো উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি করেনি। এই আন্দোলন পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ ছিল এবং দেশের মানুষ কখনও ভাবেনি যে এটি সরকারের পতনের দিকে মোড় নিবে এবং রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এখন যখন সরকার পদত্যাগ করেছে, তখন প্রশ্ন উঠছে উপাচার্যদের পদত্যাগ করা কেন জরুরি?
কেন উপাচার্যরা পদত্যাগ করছেন এবং কেনই বা এখন শিক্ষার্থীরা তাঁদের পদত্যাগ দাবি করছে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এবং শিক্ষার্থীদের চাওয়া ও উপাচার্যদের পদত্যাগের যৌক্তিকতা বোঝার জন্য, জুলাই ও আগস্ট মাসের ঘটনাপ্রবাহের গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। এই ঘটনাগুলোই বর্তমান পরিস্থিতি এবং এসব পদত্যাগের পেছনের কারণগুলো বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে।
২০২৪ সালের ১লা জুলাই বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের আকাঙ্ক্ষায় “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। কোটা আন্দোলনের অগ্নিমশালে উদ্ভাসিত শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার মাত্র ৩৬ দিন বয়সে কোটা সংস্কার ও পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনের প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা হয়ে ওঠে যার প্রখর তেজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। ২ থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। পরবর্তী দিনগুলোতেও ঢাকা সহ দেশের নানা প্রান্তে একই সুরে আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। যদিও এই কর্মসূচিগুলো ছিল শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক, তবুও শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ ও পুলিশের নির্মম আঘাতের শিকার হয়।
বর্তমান সময়ে উপাচার্যদের পদত্যাগের যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে তার বীজ রোপিত হয়েছিল ৭ জুলাই এবং তার পরবর্তী সময়ে। পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল দলীয় আদর্শ এবং দলের প্রতি একনিষ্ঠতা। এই যোগ্যতা প্রদর্শনের প্রয়াসে দেশের অধিকাংশ উপাচার্য ছাত্রলীগকে পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে। এর ফলে, ভিসিরা সাধারণ শিক্ষার্থীর স্বার্থের চেয়ে ছাত্রলীগের স্বার্থ রক্ষায় অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠেন। একই ধারায় দলীয় এবং ভিসিপন্থী শিক্ষক, কর্মকর্তা, ও কর্মচারীদের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে গিয়ে, সাধারণ শিক্ষক, কর্মকর্তা, ও কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
ফলে উপাচার্যরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিভাবক না হয়ে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর অভিভাবক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁদের কর্মের প্রতিদান আজ তাঁরা পাচ্ছে- নিজের কৃতকর্মের উপলব্ধি থেকে গিয়ে হয় স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছেন নতুবা বঞ্চিত সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে লজ্জায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন। উপাচার্যরা হয়তো মনে করতে পারেন যে সরকারের পতনের পরবর্তী অভিঘাত তাঁদের ওপরও আছড়ে পড়েছে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভিসি হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন?
তবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত ১৮ আগস্ট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের পদত্যাগ ঠেকাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এই সত্যকে প্রকাশ্যে এনেছে। বাংলাদেশে এমন ঘটনা অত্যন্ত বিরল এবং একজন উপাচার্যের জীবনে এটি একটি বিশাল প্রাপ্তি। প্রশ্ন হলো, অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন এমন কী করেছেন যা অন্য উপাচার্যরা করতে পারেননি? তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত যেখানে অন্যান্য উপাচার্যরা ছাত্রলীগের প্রতি পক্ষপাতী ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়, যখন পুলিশ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করতে চেষ্টা করছিল, অধ্যাপক মাহমুদ হোসেন পুলিশকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে বাধা দেন এবং ঘোষণা করেন, ‘আমার ক্যাম্পাসে কোনো পুলিশ প্রশাসন প্রবেশ করতে পারবে না, এখানে আমিই প্রশাসন।’ এই সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন, যা অন্য কোনো উপাচার্য দ্বারা সম্ভব হয়নি বরং পুলিশ, ছাত্রলীগ, এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয় এবং ১০-১২ হাত দূর থেকে আবু সায়িদের বুক গুলি করে ঝাঁজরা করে দেয়। আবু সাঈদ হয়তো বিশ্বাস করেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা পুলিশকে তাঁর ওপর গুলি করতে প্ররোচিত করবেন না; সে কখনোই ভাবতে পারেনি যে, তাঁরা নিজেই পুলিশকে হত্যা করার জন্য প্রণোদিত করবেন।
আবু সাঈদের মৃত্যু পুরো বিশ্বকে শিহরিত করলেও শুধু বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জাগিয়ে তুলতে পারেনি। উপাচার্য কি আবু সায়িদ হত্যার দায় থেকে মুক্তি পেতে পারেন? এক মাসেরও অধিক সময় পর আবু সায়িদ হত্যার মামলা দায়ের হলেও আসামির তালিকায় উপাচার্যের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে গভীর হতাশার জন্ম দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হয়তো আবারও প্রতিবাদ জানাবে।
উপাচার্যদের পদত্যাগের এই প্রেক্ষাপট একদিকে যেমন একটি যুগের অবসান ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি নতুন এক প্রভাতের সূচনা করছে যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই মূল চালিকা শক্তি। যদি উপাচার্যরা দলীয় আদর্শের চেয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে প্রাধান্য দেন, তবে তাঁরা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হয়ে উঠার মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত নেতৃত্বের সৌন্দর্য ও মহিমা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ (বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর)