আমাদের রেনেসাঁ, দেশ এবং দুধের মাছি সমাচার
জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষকে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে। যার ফলস্বরূপ দিনশেষে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মাঝ দিয়ে উদয় হয়েছে নতুন সূর্যের। ছাত্র জনতার ত্যাগ, তিতিক্ষা এবং অন্যায়ের সাথে আপসহীন দৃঢ় প্রতিরোধ সরকারের পেটুয়া বাহিনীর নির্মমতার বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দেশের মানুষের নিকট মুক্তির সোপান হয়ে এসেছে।
চারদিকে নব্য উদ্যোগে, নতুন স্বপ্নকে সারথি করে, নবদীপ্তির সাথে আপামর জনতা যেন তাদের নতুন চারাতুল্য স্বপ্নকে বটবৃক্ষ হিসেবে গড়ে তুলবার এক ব্রত নিয়ে এই পরিবর্তনের হাওয়ায় নিজেদের চিন্তা, চেতনাকে শান দিচ্ছে। যদি এটিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রেনেসাঁ বলেও তুলনা করা হয় হয়ত খুব একটা ভুল হবে না। কেননা জরাজীর্ণ জীবন ব্যবস্থার সাথে বাকস্বাধীনতা হরণ, গুম-খুন, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিগত সরকারের অপশাসনের দরুন মানুষের বিষিয়ে তোলা জীবনে এনে দিয়েছে এক স্বস্তির হাওয়া। এ যেন চারিদিকে বাজছে নতুনের গান!
একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ এক রেনেসাঁর সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। Gen-Z শিরোনামে যে জেনারেশান ‘আই হেইট পলিটিক্স’ বলে রাষ্ট্রীয় পলিসি এড়িয়ে যেত, তারাই এখন শয়নে স্বপনে দেশ গড়তে রাজনীতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাঝে বুঁদ হয়ে আছে। তরুণ প্রজন্মের মানসপটে এ পরিবর্তনকে নিঃসন্দেহে নবজাগরণ বলে অভিহিত করা যায়।
একমাত্র নোবেলজয়ী বাংলাদেশি ড. মো. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়েছেন। সংকট মোকাবিলায় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উনার মতন গ্রহণযোগ্যতা এই মুহূর্তে যে কারও নেই-তা নিয়ে রাজনীতিক বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্য ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ এই মুহূর্তে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। বিগত সরকারের দুর্নীতির ফলে দেশের বাইরে গেল ১২ বছরে পাচার হয়েছে প্রায় শত বিলিয়ন ইউএস ডলার। অথচ রিজার্ভ মাত্র ১৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এরকম ভঙ্গুর অর্থনীতির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দেশের হাল নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের হাতে তুলে দিয়ে ছাত্ররা দূরদর্শী এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
নতুন সরকারের জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ অপেক্ষমাণ তার মাঝে অন্যতম একটি হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা থেকে দেশের মানুষের জান, মাল রক্ষা করা। উল্লেখ্য ইতোমধ্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে অনেক মানুষ আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। এরূপ অবস্থায় দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি হাতের নাগালে রাখতে মাঠে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিকল্প নেই। কেননা গেল এক দশকের বেশি সময় ধরে পুলিশ বাহিনীতে যে-রূপ দলীয়করণ হয়েছে, এর ফলে দেশের মানুষের নিকট পুলিশের ওপর ভরসা এবং গ্রহণযোগ্যতা দুটোই কুপি বাতির মতন টিমটিম করে জ্বলছে।
পাশাপাশি পুরো দেশ ও জাতির জন্য সবচাইতে বড় অশনি সংকেত হবে রাজনৈতিক দলগুলোতে গণহারে দুধের মাছিদের অনুপ্রবেশ এবং সংকরায়ণ। এই সুবিধাবাদী শ্রেণি দেশ, জাতি ও সমাজের স্বার্থকে বিসর্জন করে নিজের আখের গোছাতে সদা ব্যস্ত থাকে। এরা নিজেদের স্বার্থে অত্যাচারী শাসকের অত্যাচারের পক্ষাবলম্বন করে এক দানব তৈরি করে। আবার সে দানবতুল্য শাসক বিদায় নিলে আরেক শাসকের কোলে উঠে দ্বিতীয় দানব তৈরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখে। যার বলির পাঠা হয় আদর্শিকভাবে স্বচ্ছ, সবল এবং নিঃস্বার্থভাবে চলা দেশের মানুষ ও রাজনীতিকগণ। ব্যাহত হয় সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সুশাসন।
দিনশেষে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশ। সময় থাকতে সুবিধাভোগী, সুযোগ সন্ধানী এবং ব্রোকার ক্লাসের মূল উৎপাটন করা না গেলে দেশের স্বার্থ এবং সুস্থ জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণ অসম্ভবপর হয়ে দাঁড়াবে। পুনরায় জাতি এক আঁধার চক্রে নিপতিত হবে।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।