নতুন বাংলাদেশ, নতুন দিনের রাজনীতি

নতুন বাংলাদেশ, নতুন দিনের রাজনীতি

এক. ছাত্র জনতার গণ অভ্যুত্থানের বেসিক প্রিন্সিপাল কী ছিল? কেন মাত্র এক মাসের মধ্যেই দুনিয়া কাঁপানো একটা গণ অভ্যুত্থানের পুণ্য ভূমি হলো বাংলাদেশ? মানুষের প্রত্যাশাটা ছিল? এক বছরের বাচ্চাকে নিয়ে এমন একটা রক্তাক্ত লড়াইয়ে এক মা কেন বুলেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো? শহিদ আবু সাঈদ, ওয়াসিম আকরাম, মুগ্ধরা জীবন দিল কেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে মানুষকে ন্যায় বিচার দেওয়ার স্পিরিটকে ধারণ করে আগামী দিনের রাজনীতির বন্দোবস্ত করা। দখলদারিত্ব,গুন্ডামি, চাঁদাবাজি আর লুটপাটের রাজনীতিকে মানুষকে ঘৃণা করে, মানুষ থুথু দেয় বলেই হাসিনা রেজিম টিকতে পারে নাই। সুতরাং বিকল্প চিন্তা, পজেটিভ পলিটিক্স করতে না পারলে যে কাউকে ছুড়ে ফেলবে বিদ্রোহী ছাত্র জনতা।

পাঁচ ই আগস্ট বলা হচ্ছে প্রায় এক কোটি মানুষ ঢাকার রাজপথে নেমে এসেছিল। সংসদ ভবন, গণভবন দখল করে বিজয় উল্লাস করলো জনতা, অবৈধ প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেল এবং বাংলাদেশ দ্বিতীয় বারের মতো স্বাধীন হলো। প্রতিটা মানুষ যারা এই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছে তাদের একটা বেসিক আকাঙ্ক্ষা আছে। এটা মনে রাখতে হবে। আর সেটা ন্যায় বিচারের আকাঙ্ক্ষা,একটা সুন্দর ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা, একটা শোষণহীন, জুলুমহীন, মুক্ত সমাজের আকাঙ্ক্ষা। গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ এই লড়াইয়ের পর এক নতুন বাংলাদেশের রাজনীতির শুভ সূচনা দেখতে চায়। রাজনীতি টাকা কামানোর মেশিন না, দখল দারিত্ব আর চাঁদাবাজির লাইসেন্সও না। এইটা মনে রাখতেই হবে। বাংলাদেশের মানুষের শেষ স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার নাম এদেশের তরুণ ছাত্র সমাজ।এদেশের তরুণ প্রজন্ম।দেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সংকট গুলোতে তরুণরাই মুক্তির বার্তা নিয়ে আবাবিল পাখির মতো এগিয়ে এসেছে। একটি চরম ফ্যাসিবাদী সরকার অবৈধ ভাবে দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে জুলুমশাহী যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এদেশের তরুণরা জাতির প্রতি তাদের দায় মোচন করেছে।এখন দায়িত্ব পালনের পালা।

দুই. প্রত্যেকটি বিপ্লব বা লড়াইয়ে কিছু প্রতিবিপ্লবী এলিমেন্টস থাকে। বাংলাদেশের এই বিজয়ও এর ব্যতিক্রম নয়। পনেরো বছরের ফ্যাসিবাদ শুধু ক্ষমতার পালাবদল হলেই শেষ হয়ে যাবে না। পুরো ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। এই যে দরুন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি দশ আগস্ট একটা ফুল কোট মিটিং ডেকে ড.ইউনুস এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে একটা জুডিশিয়াল ক্যুর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিল, সেনাবাহিনীর ভেতরের কিছু খবরও তো খারাপ ছিল, পুলিশের কর্ম বিরতি, গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর গাড়ি পুরানো, ডাকাত আতংক-এই যে প্রতি বিপ্লবী এলিমেন্টস এগুলো সম্পর্কে খুব সোচ্চার এবং সজাগ থাকতে হবেই। ফ্যাসিবাদের চিটে ফোটাও বহাল তবিয়তে রাখা যাবে না। পুরো সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। নতুন দিনের জন্য সময়োপযোগী এবং প্রেক্টিকেল পলিটিক্স করতে হবে। সে জন্যই বিপ্লব সফল হওয়ায় দায়িত্ব শেষ হয়নি। বিপ্লবীদের দায়িত্ব এখন আরও অনেক বেশি।ইতিবাচক রাজনীতি, সমস্যা সমাধানের রাজনীতি এবং মানুষের কল্যাণে মানুষের পাশে থাকার রাজনীতি ছাড়া যারা জীবন দিয়েছে তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। আপনি যদি এই বিপ্লবের কেউ হন,আবু সাঈদ, ওয়াসিম আকরাম, মুগ্ধদের আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে চান তাহলে রাজনীতি থেকে লুটপাট, দখল দারিত্ব,মাস্তানিকে বাদ দিয়ে গণ মানুষের কাতারে দাঁড়ানোর রাজনৈতিক চর্চা করতে হবে। যে ছাত্র জনতা শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্ট শাসককে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে, সেই প্রজন্ম যে কাউকেই চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। যে কোনো দুঃশাসন এবং মাস্তানিকে উপরে ফেলার হিম্মত রাখে। এটা মনে রাখতে হবে।

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে বিপ্লবী ছাত্র সমাজ অভিনন্দন জানাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের রক্ষক হয়নি। তারা জনগণের কণ্ঠস্বরকে সম্মান জানিয়ে বিপ্লবীদের উপর গুলি ছুড়েনি। বিপ্লবী ছাত্র জনতা সেনাবাহিনীর ট্যাংকের উপর উঠে উল্লাস করেছে,অভিনন্দন জানিয়েছে, ফুল দিয়েছে। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা।বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি মানুষের যে ক্ষোভ অভিমান ছিল এবার তা ধুয়ে মুছে সাফ হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মানুষ লড়াই করার একটা কমন নিরপেক্ষ ফ্ল্যাট ফর্ম খোঁজ ছিল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেই অভাব পূরণ করতে শতভাগ সফল হয় বলেই একটি সফল বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় তরুণরা। কে নেতা মানুষ এটাও খুঁজতে যায়নি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি কী শুধু এটা জেনেই মানুষ এক জীবন মরণের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। পনেরো বছর যাবত বিএনপি সহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপর যে অমানবিক নিপীড়ন নির্যাতন হয়েছে, সাধারণ মানুষকে যেভাবে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, শিক্ষাঙ্গনে যে সন্ত্রাস এবং দখল দারিত্ব চলেছে, দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি, ভয়, সন্ত্রাস, কওমি অঙ্গনের আলেম ও শিক্ষার্থীদের প্রতি জুলুম, বিডিআর হত্যাকাণ্ড, ভোট চুরি, দুর্নীতি, বিরোধী মতকে নির্মূল এসব কিছুর জবাব এই গণঅভ্যুত্থান। গোলামি করার জাতি বাংলাদেশিরা নয়। রক্তে এদের আগুন। রক্তে এদের বারুদ। সুযোগ পেলেই জ্বলে উঠে। এটা ভুলে গেলে কেমনে হবে? বাংলাদেশে শুধু এক মাসের গণঅভ্যুত্থান মনে করলে এই বিপ্লবের বাস্তবতা অস্বীকার করা হবে।২০০৯ সাল থেকে যে জুলুমের শুরু হয়েছিল ২০২৪ এ এসে তা শেষ হলো। বাংলাদেশের তরুণদের এই দুঃসাহসিক গণঅভ্যুত্থানের লড়াই সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্য প্রেরণা। যে সব মানুষ এই লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে তারাই আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়বে। এরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। এদের দায়িত্ব গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আরও অনেক বেশি।দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষোভ, যন্ত্রণা, জুলুম নিপীড়ন এবং দমিয়ে রাখার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিবাদ এই অভূতপূর্ব ছাত জনতার গণঅভ্যুত্থান।

তিন. স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববদ্যালয়ে পড়ুয়া যে মেয়েটা কিংবা ছেলেটা ঘরে নিজের কাপড়চোপড়ও নিজে ধোয়নি কোনো দিন, সে এখন ঢাকার রাজপথে, দেয়ালে দেয়ালে রংতুলির আঁচড়ে বিপ্লবের বাণী সংবলিত আলপনা আঁকছে, তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে ট্র্যাফিক পুলিশের কাজ করছে, রাস্তার ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করছে-এই দৃশ্য দেখা যাবে ঢাকার রাজপথে কেউ কোনো দিন কল্পনা করেছেন? এ এক অন্য রকম বাংলাদেশ। মুক্ত বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ।বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের জন্যই এতো লড়াই, এতো রক্ত, এতো জীবন দেওয়া। সুতরাং এই প্রজন্মের নেতৃত্ব দেয়া এতো সস্তা কিংবা সহজ হবে না। গুন্ডামি, দখলদারিত্ব এবং মাস্তানি-এই প্রজন্মের কাছে খুব ফালতু বিষয়। ওরা যে কারও দুঃশাসনকে চ্যালেঞ্জ করে বসবে। এমন একটা রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বেড়ে উঠার জন্য খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে ছাত্র সংগঠন গুলোই মূলক জনগণের রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের ছাত্র জনতার বিপ্লবে এটা আবারও প্রমাণ হলো। এখন সময় নতুন দিনের জন্য, নতুন রাজনীতির ব্যবস্থা করা। বিপ্লবের চেতনাকে বাস্তবায়ন করা। যে স্বপ্ন নিয়ে শত শত তরুণ বুলেটের সামনে জীবন বাজী রেখেছে তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করা। এটাই এখন গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া ছাত্র জনতার দায়িত্ব।

বাংলাদেশে কোনো ইজমের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নেই। প্রয়োজন একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণ রাষ্ট্রের রাজনীতির চর্চা বাড়ানো। ছাত্র জনতার বিপ্লবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক দর্শনটা সিরিয়াসলি কাজ করেছে। সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়টাই আন্দোলনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে খ্রিষ্টান, কে বৌদ্ধ, কে ডান -বাম- মধ্যম- উদারপন্থি এইসব এই লড়াইয়ে বড় হয়ে আসেনি। ফ্যাসিবাদ বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে কয়েক জন হিন্দু তরুণও জীবন দিয়েছে। সুতরাং রাজপথে বাংলাদেশের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস লেখা হয়েছে সব ধর্ম, বর্ণ,গোত্র,বিশ্বাসের মানুষের রক্তের অক্ষরে। মুক্তিযুদ্ধের মতোই এই লড়াইয়েও সবার আত্মত্যাগের রক্ত এক মোহনায় মিলিত হয়েছে। এজন্যই বাংলাদেশে সব মানুষের রাষ্ট্র কায়েম করা এখন গণ অভ্যুত্থানে অংশ গ্রহণকারী প্রতিটি কর্মীর দায়িত্ব। 

এটা বাংলাদেশের জনগণের গর্ব করার মতো একটা ঘটনা যে এদেশের তরুণরা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে মুক্তি এনেছে। 
এখন সময় দেশটাকে নতুন করে গড়ার। এখন সময় পরিচ্ছন্ন রাজনীতিকে প্রমোট করার। এখন সময় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গুন্ডামি আর মাস্তানতন্ত্রের করব রচনা করার। এটাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া প্রতিটি কর্মীর দায়িত্ব।

লেখক: সহ- সভাপতি, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ


সর্বশেষ সংবাদ