গ্রেপ্তার ও আটক: সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা
বর্তমান সময়ে ‘গ্রেফতার-আটক’ শব্দটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় হয়ে উঠেছে ভয়, আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে, গুম, নিখোঁজ হওয়া, বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সহ নানাবিধ কারণে জনমনে এ আতঙ্ক আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ার সময় কোন ধরনের আইনি অধিকার পাবেন এবং গ্রেফতার–পরবর্তী আইনি পদক্ষেপগুলো কী হবে, তা আমাদের জানা থাকা দরকার।
কোনো ব্যক্তি গ্রেফতার হলে তার কিছু অধিকারের নিশ্চয়তা বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনে দেয়া হয়েছে। কোন কোন পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি গ্রেফতার হতে পারেন বা গ্রেফতারের আগে ও পরে তার কী কী অধিকার রয়েছে সে সম্পর্কেও আইনে বিস্তারিত রয়েছে। গ্রেফতার ও আটক অবস্থায় এ সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী আপনার অধিকার ও পুলিশের কর্তব্য নির্ধারিত হয়।
জেনে নেওয়া যাক 'গ্রেফতার - আটক' সম্পর্কে বাংলাদেশ সংবিধানে কি বলা আছে বা গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে সাংবিধানিক কি কি দায়বদ্ধতা আছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে ‘গ্রেফতার আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ’ শিরোনামে গ্রেফতার ব্যক্তিদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে। প্রথম দফায় বলা হয়েছে, গ্রেফতারের কারণ না জানিয়ে কোনো ব্যক্তিকে আটক করা যাবে না এবং আটক ব্যক্তিকে অবশ্যই তাঁর মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। ওই অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় দফায় আরও বলা হয়েছে, আটক ব্যক্তিকে অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থিত করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তিকেই ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় আটক রাখা যাবে না।
সংবিধান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ক. গ্রেফতার ব্যক্তির গ্রেফতারের কারণ জানা, খ. গ্রেফতারের পর আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করা এবং গ. আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ লাভ হচ্ছে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সেই সঙ্গে সংবিধান অনুসারে গ্রেফতার ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ব্যতীত ২৪ ঘণ্টার অধিক আটক না রাখা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতি সংবিধানের নির্দেশনা।
তবে বিদেশি শত্রু ও যাঁকে ‘প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন’ বা নিবর্তনমূলক কারণে আটক করা হয়েছে, সেই সব ব্যক্তি এই সাধারণ সাংবিধানিক অধিকারগুলো পাবেন না।
সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের বর্ণিত অধিকারের মধ্যে ফৌ: কা: ৬০ ধারায় আটককারী পুলিশ কর্মকর্তা আটককৃত ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অর্পণ এবং ৬১টি ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ব্যতীত আটককৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় আটক না রাখার বিধান বর্ণিত হয়েছে। ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে স্বাভাবিকভাবে নন জিআর মামলা হিসেবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করতে হয়। এরপর আদালত একজন আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন প্রদান করে থাকেন।
এক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তা যদি কোনো প্রতারণার আশ্রয় প্রশ্রয় নিয়ে আটক করেন সেক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে। আর যদি আইনসংগত উপায়ে পুলিশ কর্মকর্তা আটক করেন সে ক্ষেত্রে আদালত যুক্তিযুক্ত বিষয়াদি বিবেচনা করে আটককৃত ব্যক্তিকে কারাগারে প্রেরণ নতুবা তৎক্ষণাৎ মুক্তি দিতে পারেন।
বিগত ২০০৩ সালে ৭ এপ্রিল তারিখে ৫৪ ও ১৬৭ ধারায় গ্রেফতার ও রিমান্ডের বিষয়ে ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশে মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ বিস্তারিত আলোচনা শেষে ও কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ২৫ মে হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া রায় বহাল রেখে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের রায়ে যে সব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিলে সেগুলো হলো- ক. আটকাদেশ (ডিটেনশন) দেওয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করতে পারবে না। খ. কাউকে গ্রেফতার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ. গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে এর কারণ জানাতে হবে। ঘ. বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য স্থান থেকে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়কে এক ঘণ্টার টেলিফোন বা বিশেষ বার্তাবাহক মারফত বিষয়টি জানাতে হবে। ঙ. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে তার পছন্দমতো আইনজীবী ও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে। চ. গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের ভেতরে কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবে। ছ. জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। ট. পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ড যদি বলে ওই ব্যক্তির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং তাকে পেনাল কোডের ৩৩০ ধারায় অভিযুক্ত করা হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়