দল মত নির্বিশেষে, দেশটা তো আমার, আমাদেরই
সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলি সম্পর্কে আমি আমার ব্যক্তিগত কিছু অবজারভেশন ব্যক্ত করবো। হয়ত অনেকে হাসবেন বা আমার কথা পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেবেন। তাদের মতামতের প্রতি আগেই শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিমত জানাচ্ছি।
প্রথমে একটু পেছনের ইতিহাস টানি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে সিআইএ জড়িত ছিল, সেটা সর্বজনবিদিত। কারণ হিসেবে বলা যায়, তৎকালীন সময়ে কোল্ড ওয়ারে রাশিয়ান সমাজতন্ত্র বনাম আমেরিকান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার লড়াইয়ের কথা।
তখন রাশিয়ান বলয়ের প্রভাব বিস্তার ও আমেরিকান বলয়ের প্রভাব বিস্তারের লড়াই চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় রাশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপে সমাজতান্ত্রিক প্রভাব বিশ্বে বাড়বে বলে আমেরিকা সরাসরি এর বিরোধিতা করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সহযোগিতায় সপ্তম নৌবহর পাঠায়।
বাংলাদেশের জন্ম তাই আমেরিকার জন্য হুমকি স্বরূপ ছিল।
বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল ঘোষণা করলেন, সেটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুরূপ বলে আমেরিকা সেটা স্বভাববশতই ঠেকাতে চাইলো।
তখনকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, যে-সকল দেশ সমাজতন্ত্রের পক্ষে পদক্ষেপ নিচ্ছে বা রাষ্ট্রক্ষমতায় সমাজতান্ত্রিক সরকার বসেছে, সি আই এ-র তত্ত্বাবধানে সেসব দেশে ক্যু হয়েছে, রাষ্ট্রনায়ক খুন হয়েছে, হঠাৎ স্থানীয় ইস্যু নিয়ে বিপ্লব হয়েছে, ক্ষমতায় এসেছে আমেরিকান পুতুল সরকার কিংবা যেখানে সম্ভব হয়নি সেখানে সমাজতন্ত্রবিরোধী রাজনৈতিক দল। এটাকে আমেরিকার ভাষায় ডোমিনো থিওরি বলে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়-
১৯৫৩ - ইরানে ক্যু
১৯৬১ - কিউবায় বে অফ পিগস ইনভেশন
১৯৬৭- ইন্দোনেশিয়ায় সুকার্নোকে সরিয়ে জেনারেল সুহার্তোর আসা
১৯৯১ - সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন
সবগুলি উল্লেখ করলাম না, লিস্ট অনেক লম্বা। গবেষণা বলে, ১৯৪৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিআই এ বা আমেরিকা ৬৪ টি কোভার্ট বা গোপন অপারেশন চালিয়েছে পৃথিবীব্যাপী নিজেদের স্বার্থ রক্ষায়। সর্বশেষ ভেনিজুয়েলার সরকার বিরোধী আন্দোলনের কথা হয়তো আপনারা জানেন। মাদুরোর সরকার উৎখাত করতে গুয়াইডোকে সরাসরি আমেরিকা সমর্থন দেয়।
বর্তমানে চীন বনাম আমেরিকার ঠান্ডা লড়াই কারোর কাছে গোপন কোন খবর নয়। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পাশে দাঁড়ানোয় চীনের প্রতি স্বভাবতই আমেরিকা ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ।
খুব সংক্ষেপে লিখলাম, এই টপিকেই আলাদা করে বড় একটা লেখা লেখা যায়।
এবার আসি সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে।
জুন মাসের ৫ তারিখে হাইকোর্টের রায় আসে কোটা বাতিলের সরকারের সিদ্ধান্তের বাতিলের। জুনের ৬ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত স্বল্প আকারে আন্দোলন চলে। হাইকোর্টের কোটা বহাল রাখার রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করে।
প্রধানমন্ত্রী চীন যাবেন, সে সফরের পরিকল্পনা হয় এর ভেতর এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। জুনের মাঝামাঝির দিকে। জুনের ৩০ তারিখ থেকে আবারো আন্দোলন দানা বাঁধে। প্রধানমন্ত্রী চীন যাবার আগেরদিন "বাংলা ব্লকেড" এর ঘোষণা আসে।
চীন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী দেশে আসেন, চীন এক বিলিয়ন ইউয়ান অনুদানের ঘোষণা দেয়। পায়রা বন্দর সহ বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের চুক্তি হয়। একই সাথে চীনের জাতীয় রাজনৈতিক দলের সাথে ও চীন সরকারের সাথে কয়েকটি সমঝোতা চুক্তি হয়। চীনের জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের সাথে "বিটিভি"-র কয়েকটি চুক্তি হয়।
প্রধানমন্ত্রী ফিরে আসার আগ পর্যন্ত আন্দোলন শাহবাগ ও ঢাকা ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রিক ছিল। উনি ফিরে আসার পরদিন থেকে শুরু হয় বিভিন্ন কলেজ ও ইউনিভার্সিটির আন্দোলনে যোগদান। পরদিন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা আসে।
১৫ জুলাই বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে বলা হয় ছাত্রদের হলে আটকে রেখেছে, মিছিল করে "আটকে রাখা" ছাত্রদের উদ্ধারে যায় আন্দোলনকারীরা, বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের উপর আক্রমণ হয়, ছাত্রলীগ পালটা আক্রমণ করে, দিনভর সংঘাত চলে।
ব্লুমবার্গ সহ বিভিন্ন পত্রিকায় ইউনুস সাহেবের বক্তব্য ছাপা হয়, উনি বলেন, আমি চাইলে সরকার এক মিনিটও ক্ষমতায় থাকতে পারতো না।
ইউ এস এমব্যাসী মারামারি শুরু হবার আগেরদিন সন্ধ্যায় বিবৃতি দেয়, বিবৃতিতে "দুজন মারা গেছে" বলে জানানো হয়, অথচ সেদিন পর্যন্ত কেউ মারা যায় নি।
জুলাইয়ের ১৬ তারিখে দেশব্যাপী সংঘাতে মারা যায় কয়েক জন। আঠারো তারিখে আন্দোলন থেকে "কমপ্লিট শাটডাউন" কর্মসূচি ঘোষণা আসে।
ইউ এস এমব্যাসী শুধু আমেরিকান নাগরিক ছাড়া বাকি সবার জন্য সেবা বন্ধ করে এমব্যাসী কর্মকর্তাদের শেল্টারে চলে যাবার নির্দেশ দেয়। বৃহস্পতিবার এম্ব্যাসী পুরোপুরি বন্ধ থাকবে বলে জানায়।
দেশব্যাপী সংঘর্ষে ছাত্র, সাধারণ জনতা, ছাত্রলীগ কর্মীসহ মারা যায় অনেকে। বিটিভি পুড়িয়ে দেয়া হয়, ত্রাণ ভবন, সেতু ভবন পুড়িয়ে দেয়া হয় এবং ফায়ার ব্রিগেড যেন ঢুকতে না পারে সেজন্য পাহারা বসানো হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় মেট্রোরেল, যাত্রাবাড়ি টোল প্লাজা, ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হলো নরসিংদীতে আন্দোলনকারীরা আক্রমণ করে জেলখানায়, ৮২৬ জন কয়েদি পালিয়ে যায়। ৮৫ টি অস্ত্র এবং দশ হাজার রাউন্ড গুলি লুট হয়। পালিয়ে যাওয়া কয়েদিদের ভেতরে ছিল ব্লগার হত্যার আসামি আনসার আল ইসলামসহ জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রায় দশজন আসামি।
সরকার কারফিউ জারি করে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।
এর পরের ঘটনা মোটামুটি সবার জানা, বা হয়ত অজানা।
আপিলের রায়ে কোটা সংস্কার করা হয়। আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা আসে।
আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান গতকাল, তাকে বাংলাদেশের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে জানিয়ে লিংকডইনে তিনি বলেন, এভাবে যেতে তার খুব খারাপ লাগছে। লাগারই কথা, মিশন সাকসেসফুল হয় নি।
এর ভেতর খুবই লক্ষণীয় বিষয়, আন্দোলনের কর্মসূচি গুলির নাম, ইংরেজি। আমি বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন আন্দোলনের কর্মসূচির নাম ইংরেজিতে দিতে দেখিনি। ভুল বলে থাকলে জানাবেন।
হতেও পারে আমি হয়ত অতিকল্পনা করছি, হতেও পারে আমি ভুল। কিন্তু ইতিহাস দাগ রেখে যায়। আজ নাহোক, একদিন সব প্রকাশিত হবে।
ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলন নিয়ে কোনো কথা আমার নেই। আমি আন্দোলনের মানুষ, যেকোনো যৌক্তিক আন্দোলনে আমার নৈতিক সমর্থন থাকে।
কিন্তু আন্দোলনের পর্দার পেছনের বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকেই আমার ভয়। আর সে ষড়যন্ত্র যদি হয় আমেরিকা তথা সিআই এ পরিচালিত, বাংলাদেশের সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে আমি আতঙ্কিত হই, ভয় পাই।
দল মত নির্বিশেষে, দেশটা তো আমার, আমাদেরই, তাই না?
(অনেক কথা হয়ত বাদ গেছে, আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি মানুষ মাত্র, সবকিছু মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি)
লেখক: ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট (শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম কর্মী)