কোটা পদ্ধতির সংস্কার যেভাবে হওয়া উচিত
১৯৭২ সালের গণপরিষদে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাহাত্ম্য ও কীর্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কখনও কোটা নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে ইন্টেরিম রিক্রুটমেন্টে (অন্তর্বর্তীকালীন নিয়োগ) ৩৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ক্যাডার সার্ভিসে আনা হয়েছিল। ইন্টেরিম রিক্রুটমেন্ট বিষয়টিই সাময়িক সময়ের জন্য। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও এটিকে দীর্ঘায়িত করতে চাননি বরং তিনি সবসময় মেধাকে মূল্যায়ন করেছেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার যৌবনের বেশির ভাগ সময় কারাগারে কাটিয়েছিলেন, সময়ের হিসেবে তা ১২ বছরের অধিক সময়। উদ্দেশ্য ছিল একটিই বাঙালি জাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণ মুক্তি। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিবসে তিনি বলেছিলেন, "এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।"
বাংলাদেশের সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদে বীরমুক্তিযোদ্ধার সন্তান সন্ততি বা নাতি-নাতনিকে সরকারি চাকরি লাভে কোনোরকম বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা নেই। বরং সংবিধানের তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশে ২৯নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী-
২৯। (১) প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।
(২) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।
(৩) এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই-
(ক) নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে,
(খ) কোন ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত প্রতিষ্ঠানে উক্ত ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নিয়োগ সংরক্ষণের বিধান-সংবলিত যে কোন আইন কার্যকর করা হইতে,
(গ) যে শ্রেণীর কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তাহা নারী বা পুরুষের পক্ষে অনুপযোগী বিবেচিত হয়, সেইরূপ যে কোন শ্রেণীর নিয়োগ বা পদ যথাক্রমে পুরুষ বা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।
১৯৭৫ সালের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলোর অপতৎপরতায় বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছেন।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর ১৯৭৫-১৯৯৬ পর্যন্ত বীরমুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে যে বঞ্চনা ও শোষণ করা হয়েছিলো তার ক্ষতিপূরণের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা সকল ধরনের সরকারি চাকুরিতে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করেন, যা ছিল একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।
১৯৯৭-২০১৮ পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর বীরমুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যগণ এই সুবিধা ভোগ করেছেন। কিন্তু দেশের একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে অনেক বছর একই হারে সুবিধা প্রদান করলে তা হবে দেশের অগ্রযাত্রার পথে বাধা। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনা সকল ধরনের বৈষম্য দূর করতে ২০১৮ সালে মহান সংসদে বলেছিলেন, "কোনো কোটাই থাকবে না, কোনো কোটারই দরকার নেই।" (১১ এপ্রিল ২০১৮, জাতীয় সংসদ)
তারই প্রেক্ষিতে নির্বাহী বিভাগ ৯ম গ্রেড (১ম শ্রেণি) এবং ১০ম-১৩তম গ্রেডের(২য় শ্রেণি) চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে সকল ধরনের কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
কিন্তু গত জুনে হাইকোর্ট বিভাগ সেই প্রজ্ঞাপনকে বাতিল করে কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত প্রদান করে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% সহ সবমিলিয়ে ৫৬% কোটা দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি স্পষ্ট বৈষম্য। যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা বিমুখ করতে পারে। আবার ২০১৮ সালের মতো একেবারে বাতিল করে দিলেও পরবর্তীতে এই সমস্যা আবারও সৃষ্টি হতে পারে, যা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত করতে পারে।
তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের পক্ষে। কিন্তু এটা একটু ডাইনামিকভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। যেমন-
- নাতি নাতনিদের ওপরে সন্তান প্রাধান্য পাবেন।
- একাধিকবার কোটা সুবিধা ভোগ করা যাবে না।
- যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান অগ্রাধিকার পাবেন।
- অর্থনৈতিক অসচ্ছলতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
- নাতি বা নাতনির পরের প্রজন্ম এই সুবিধাভোগী হবেন না।
সর্বোপরি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবশ্যই ৯৫% মেধা ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করতে হবে এবং বাকি ৫% সকল ধরনের কোটা আওতাভুক্ত হবে।
লেখক: উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।