সর্বজনীন পেনশন উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে অন্তরায়
পেনশন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যেকোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার আওতায় আনা হয়ে থাকে। যথাযথ পেনশন সুবিধার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার অবসরোত্তর জীবন নির্বিঘ্নে কাটাতে পারেন। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান পেনশন ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা দেশের সকল স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আগামী ১ জুলাই থেকে ‘প্রত্যয় স্কিম’ চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে কোন আলোচনা-পর্যালোচনা ব্যতীত এমন সিদ্ধান্ত সর্বমহলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এবং সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো ‘প্রত্যয় স্কিমে’ অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বিষয়ে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে অবহিতকরণের চেষ্টা করছেন।
পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী স্ব-শাসিত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিগণ প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হলে অবসরগ্রহণকারীদের অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় অনাগ্রহী হয়ে পড়বেন। উচ্চশিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মজার বিষয় হলো তথাকথিত প্রত্যয় স্কিমকে সর্বজনীন বলা হলেও বাস্তবিকপক্ষে এটি সর্বজনীন নয়। কারণ সরকারের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও বিচার বিভাগকে এই স্কিমের আওতাভুক্ত করা হয় নাই। একইসাথে এটি স্বায়ত্তশাসন ধারণার সাথে সাংঘর্ষিকও বটে। বর্তমানে প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থাপনার সাথে প্রত্যয় স্কিমের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো:
১. বর্তমানে প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী অবসরে যাওয়া ব্যক্তিদের প্রদেয় অর্থ প্রতিবছর শতকরা পাঁচ ভাগ হারে বৃদ্ধি পাবে৷ প্রত্যয় স্কিম চালু হলে শুধুমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিগণ এই সুবিধাভোগী হবেন। চলমান পেনশন ব্যবস্থাপনায় অবসরোত্তর ভাতাকে প্রচলিত মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয় করা হয়ে থাকে। কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে তা অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই।
২. প্রত্যয় স্কিম অনুসারে একজন ব্যক্তির মূল বেতনের ১০% মাসিক হারে কর্তন করা হবে। অথচ প্রচলিত পেনশন ব্যবস্থাপনায় মূল বেতন থেকে কর্তনের কোনো বিধান নেই। সেই সাথে বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী একজন ব্যক্তি অবরকালীন সময়ে এককালীন অর্থ সুবিধা ও মাসিক পেনশন প্রাপ্য হয়ে থাকেন। কিন্তু বৈষম্যমূলক প্রত্যয় স্কিমে এককালীন আনুতোষিকের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয় নাই।
৩. প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একজন ব্যক্তির চাকুরিকালীন সময়সীমা পাঁচ বছর হলে তার পরিবারের সদস্যরা নির্ধারিত হারে মাসিক পেনশন সুবিধা প্রাপ্য হয়ে থাকেন, পক্ষান্তরে প্রত্যয় স্কিমের আওতায় একজন ব্যক্তির চাকুরিকালীন সময়সীমা ১০ বছরের কম হলে শুধু জমাকৃত অর্থ ও এর মুনাফা প্রাপ্য হবেন। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের পরিবার প্রচলিত নিয়মে সুবিধাভোগী হবেন যা অত্যন্ত প্রহসনমূলক।
৪. চলমান নিয়ম অনুযায়ী অবসরভোগীর অবর্তমানে তার স্ত্রী, স্বামী অথবা প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর সঙ্গে অবসরভোগীর বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ প্রত্যয় স্কিম অনুযায়ী অবসরভোগী কোন ব্যক্তি ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবারের কোন সদস্য পেনশন সুবিধার জন্য বিবেচিত হবেন না। এর ফলে তার পরিবার সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে চরম অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হবেন।
৫. বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬৫ বছর। কিন্তু প্রত্যয় স্কিল চালু হলে একজন শিক্ষক ৬০ বছর বয়সে পেনশন ব্যবস্থার আওতাভুক্ত হবেন। যার ফলে তাদের শিক্ষা ও গবেষণার কার্যকাল হ্রাস পাবে ফলশ্রুতিতে দেশ ও জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়াও প্রত্যয় স্কিম অনুযায়ী চাকুরিকালীন সময়ে একজন ব্যক্তির অর্জিত কিন্তু অভোগকৃত ছুটির নগদায়ন সম্ভব নয় যা তাকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ইউনেস্কোর মানদণ্ড অনুযায়ী দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য মোট বাজেটের ৬% শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেওয়া উচিত। সাম্প্রতিক বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ ছিল মোট বাজেটের ১.৭৬% এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১.৬৯% যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এটি গভীর উদ্বেগের বিষয় প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিবেচনা না করে এবং প্রয়োজনীয় ভৌত ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত না করেই যত্রতত্র বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলোতে নেই মানসম্মত শিক্ষক, উন্নত গবেষণাগার এবং গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ যা উচ্চশিক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ। বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাজুক অবস্থান আমাদের শিক্ষাখাতের দুর্বলতা এবং নীতিনির্ধারকদের অবহেলাকে নির্দেশ করে। গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা দেশের টেকসই উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষা এবং গবেষণায় আনুপাতিক হারে বরাদ্দ বাড়ানো, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণের কোন বিকল্প নেই।
সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সর্বনিম্ন যা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণায় পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। যার ফলে দেশ ও জাতি আগামী দিনে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষকরা দেশ ও জাতি গঠনের কারিগর।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য তাদের সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর (ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান) চেয়েও অপ্রতুল। শিক্ষক সমাজের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা ব্যতীত শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। পরিশেষে বলতে চাই, মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলতে এবং শিক্ষক সমাজের সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাদের দীর্ঘদিনের যৌক্তিক দাবি ‘স্বতন্ত্র বেতন স্কেল’ বাস্তবায়ন করা হোক এবং একইসাথে প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে বাতিল করা হোক ৷
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।