এখন আর ঈদে আগের মতো আনন্দ নেই

গিয়াস উদ্দিন রিয়াদ
গিয়াস উদ্দিন রিয়াদ  © টিডিসি ফটো

শুরুতেই বলি, এখন আর ঈদে আগের মতো আনন্দ নেই। ঈদের দিন বিকেল থেকে আমরা ছেলেরা ডেলিভারির কাজ করতাম মানে, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি গিয়ে গিয়ে মাংস দিয়ে আসতাম। এটা অন্যরকম আনন্দের কাজ ছিল। কিন্তু এসব সংস্কৃতির অনেককিছুই হারিয়ে গেছে। আগের মতো উঠোনে একসাথে সবাই বসে মাংস রুটি খাওয়ার দৃশ্য এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। 

যাহোক, কোরবানির ঈদ হচ্ছে মুসলমানদের জন্য ত্যাগের ঈদ। রমজানের ঈদের ঠিক মাস দুয়েক পরেই ত্যাগের মহিমা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় ঈদ-উল-আযহা। সঠিকভাবে কোরবানি করার মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর নিকট ত্যাগের পরীক্ষা দিই। এই ঈদকে কেন্দ্র করে আমাদের ছোটবেলার নানারকম স্মৃতি রয়েছে। ছোটবেলায় একটা গান শুনতাম,

"ভাইজান খবর একখান, খবর একখান, দেরি হইয়া যায়, আতর লাগাই ঈদ এর নামাজ ফরি ও ফেলায়, ভাই জান খবর একখান। এক বোতল এ দুই এক খুশি আমরা মুসলমান, একখান হইল রমজানের ঈদ, আরেকখান কোরবান, ভাইসাব RC Cola খান।"

বিজ্ঞাপনের এই গানটি আমাদের মাঝে কোরবানির ঈদের আমেজ সৃষ্টি করে। ছোটবেলায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভির) সাদা কালো পর্দায় এই বিজ্ঞাপন যখন দেখতাম তখনই মনের মধ্যে অন্যরকম খুশি লাগা কাজ করতো। তারপর আসে গরু-ছাগলের হাঁট। 

ঈদের ঠিক এক সপ্তাহ আগে থেকে এই হাটগুলো বসে। সারাদিন রিকশা সিএনজি নিয়ে মাইকিং করা হয়, অমুক জায়গায় তমুক জায়গায় এক বিশাল গরু-ছাগলের হাঁট বসবে। আমরা বন্ধুরা মিলে মায়ের কাছ থেকে ১০-২০ টাকা নিয়ে দলবদ্ধ গরুর হাঁটে চলে যেতাম। পুরো বাজার ঘুরে ঘুরে গরু দেখতাম। গরুর হাটের আশপাশ তখন মেলার মতো হয়ে যেত। কোথাও বাদাম, কোথাও ঝালমুড়ি, কোথাও আচার, কোথাও আইসক্রিম এসব বিক্রি হতো। মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসা টাকা দিয়ে আমরা সেগুলো কিনে খেতাম।

বাবা-চাচাদের হাত ধরে নিজেদের গরু কেনার জন্যও হাঁটে চলে যেতাম। গরু কেনা হয়ে গেলে তার গলায় মালা পরিয়ে নিতাম। তারপর রশি ধরে টেনে টেনে গরু বাড়ি নিয়ে আসতাম। মাঝেমধ্যে গরু পাগলাটে দৌড় দিত, পেছনে পেছনে আমরাও দৌড় দিতাম। কী সুন্দর দিন ছিল!

সবচেয়ে বেশি মজা হতো গরু বাড়িতে নিয়ে আসলে। তার জন্য ঘাস কাটা, তাকে খাওয়ানো, গোসল করানো, বিকেলে চরাতে নিয়ে যাওয়াসহ সব কাজেই অন্যরকম আনন্দ কাজ করতো। ঈদের আগের ২-৩ দিনের জন্য আমরা এক একজন রাখাল হয়ে যেতাম। 

ঈদের দিন নামাজ পড়ে এসে তাড়াতাড়ি গরুর কাছে চলে যেতাম। তাকে গোসল করিয়ে পানি খাইয়ে দিতাম। তারপর হুজুর এসে গরু জবাই দিতো। তখন গরুটার জন্য অনেক মন খারাপ হতো। কিন্তু আল্লাহর পথে কোরবানি কিছু করার নাই। 

কোরবানির ঈদ মানে চালের রুটি আর গরুর মাংস। একদিকে আমরা মাংস কাটাকাটিতে ব্যস্ত থাকতাম, অন্যদিকে আমাদের মা বোনেরা সবাই রান্নায় ব্যস্ত থাকতো। ছোটবেলায় দেখতাম বাড়ির উঠোনে মাদুর বিছিয়ে সবার ঘর থেকে মাংস রুটি নিয়ে এসে একসাথে খাওয়া হতো। সেখানে বাড়ির ছোট্ট শিশু থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি সবাই থাকতো। একসাথে খাওয়ার সেই যে কী আনন্দ। 

ক্যাম্পাসে এই নিয়ে চতুর্থবার কুরবানির ঈদ পালন করবো। ক্যাম্পাস জীবনের পাঁচ বছরের পাঁচটি ঈদের মধ্যে একটা বাড়িতে পালন করেছি। তখন দেখেছি, ছোটবেলার নানারকম স্মৃতি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বন্ধু বান্ধব নাই, গরুর হাঁটে গিয়ে সেই ঝালমুড়ি, আচার খাওয়ার বয়সও নাই। আগে যে আমেজ কাজ করো এখন মানুষের মধ্যে আগের মতো সেই ঈদের আমেজও নাই। শৈশবের সেই সোনালি দিনগুলো এখন শুধু স্মৃতিতে।

বড় হওয়ার সাথে সাথে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া, নানাবিধ সমস্যা, স্টুডেন্টদের পরীক্ষা, নিজের অ্যাকাডেমিক চাপসহ বিভিন্ন কারণে আমার মতো অনেকেরই এখন আর বাড়ি যাওয়া হয় না। ক্যাম্পাসেই নিঃসঙ্গ ঈদ কাটে। হলগুলো ফাঁকা থাকে; ক্যান্টিন ডাইনিং দোকান পাট সব বন্ধ থাকে। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। ঈদের নামাজ পড়ে এসে লম্বা একটা ঘুম দেয়া, দুপুরে উঠে রান্নাবান্না করে খাওয়া-দাওয়া করা, এভাবেই কাটে ক্যাম্পাসের ঈদ। বিষণ্ন সুন্দর ঈদ।

কোরবানির ঈদ যেহেতু ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার ঈদ, সুতরাং আমাদের উচিত আমাদের চারপাশে মানুষদের নিয়ে ঈদ উদযাপন করা। যাদের কোরবানি করার সামর্থ্য নাই তাদের খোঁজখবর নেয়া, তাদের হক আদায় করা আমাদের দায়িত্ব। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলেমিশে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হই। সবাইকে সাথে নিয়ে সুন্দর এক ঈদ কাটুক এই প্রত্যাশাই করি।

লেখক: শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

সর্বশেষ সংবাদ