স্মৃতির ভেলায় ঈদ আসে
ঈদের আনন্দ আর উৎসবের কথা ভাবতে গেলেই আমার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে শৈশবের ঈদ। দাদার হাত ধরে গ্রামের মেঠো পথ ধরে তাকবীর পড়তে পড়তে ঈদগাহে যাচ্ছি। গ্রামের এক কোণে শেওলা পড়া ঈদগাহের মেঝে—চারপাশ ঈদের আগের দিন ঝকঝকে করে ধোয়া হয়েছে। ঈদগাহের দুইধারে সার বেঁধে খেলনার দোকান, ছোট ছেলে-মেয়েরা ছোটাছুটি করছে। নামাজ শেষে গ্রামের মুরব্বিদের সাথে কবরস্থানে যাওয়া, বাড়ি ফিরে হাতে বানানো হরেক রকম সেমাই পিঠা খাওয়া। শহুরে আবহে এখন তার কোনটিই নেই। তবুও শৈশবের স্মৃতির ভেলায় করে ঈদ আসে বারবার, রাঙিয়ে দেয় আমাদের মন।
আমাদের ঈদের আবহ শুরু হতো ১০-১৫ দিন আগে থেকেই। মহল্লার দোকানগুলোতে ঈদের ‘ভিউ কার্ড’ পাওয়া যেতো। আর রাস্তার দু’ধারে আমাদের বয়সী অনেকেও বসে যেতো ঈদকার্ডের পসরা সাজিয়ে। ঈদকার্ড ছাড়া তখন ঈদ ঠিক জমে উঠতো না। আগেভাগেই স্কুলের বন্ধুদের মাঝে ঈদকার্ড বিনিময় চলত। অবশ্য বাজারে কেনা ঈদকার্ডের চেয়ে নিজে বানানো ঈদ কার্ডটাতেই বেশি আনন্দ ছিলো। ক্যালেন্ডারের পাতা কিংবা ভারি কাগজে জরি ও রঙিন কলম দিয়ে ঈদকার্ড বানানো হতো।
স্কুলে ঈদের ছুটির নোটিশ দেয়ার পর আমরা বাবা-মায়ের সাথে রওনা দিতাম গ্রামের বাড়ি। এখনকার মতো ঈদযাত্রার ভোগান্তি তখন ছিল না। দাদাবাড়ি যাওয়া আমাদের কাছে ছিল উৎসবের মতো। চাচাতো ভাইবোনরা সবাই মিলে মেতে উঠতাম ঈদ আনন্দে, সবাই মিলে পরিকল্পনা করতাম কিভাবে ঈদের ছুটির সময়টা কাজে লাগানো যায়।
সপ্তাহখানেক আগে থেকেই বাড়িতে সেমাই তৈরির ধুম পড়ে যেতো। এক ধরনের মেশিন ছিল টিউবওয়েলের মতো দেখতে। এর একপাশ দিয়ে ময়দা চেপে চেপে দেয়া হতো; হাতল ঘুরালে অন্যপাশ দিয়ে মোটা মোটা সেমাই বের হতো। দুই-তিন বাড়ি মিলে হয়ত একটা সেমাইয়ের মেশিন পাওয়া যেতো। এঘর থেকে ওঘর হয়ে পালাক্রমে আমাদের ঘরে আসতো। সেদিন উঠোন জুড়ে সেমাই শুকাতে দেয়া হতো। আমরা ভাইবোনরা মোড়া পেতে পাহারা দিতাম।
ঈদের চাঁদ না দেখলে এ আনন্দে যেন শতভাগ পূর্ণতা আসতো না। ২৯ রোজা শেষ হলেই ইফতার সেরে দৌড় দিতাম চাঁদ দেখতে। দেখা না গেলে ৩০ রোজা রাখতাম। রোজার শেষ দিনে মাগরিবের পর পশ্চিমের আকাশে দিকে তাকিয়ে থাকতো পাড়ার সবাই। এমনও হয়েছে চাঁদ দেখার জন্যে ছেলেদের কেউ কেউ গাছে উঠে যেতো। আর ঈদুল আযহার আমেজ বোঝা যেত পাড়ায় সবার গরু কেনার ধুম দেখে। অবশ্য কোরবানি দিতো এমন সামর্থ্যবান পরিবারের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। গ্রামের কাছারি ঘরের সামনে সবার গরু বেঁধে রাখা হতো। আর পালা করে সবাই মিলে পাহারা দিত। ঈদে চাঁদ দেখা গেলে ছোটরা সবাই মিলে ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক স্লোগানে মিছিল বের করতাম।
চাঁদ দেখে ঈদ নিশ্চিত হওয়ার পর আতশবাজি খেলায় মেতে উঠতাম পাড়ার সবাই মিলে। আর মেহেদি পরার জন্য ধরনা দিতাম বড় আপাদের কাছে। পুরো বাড়িতে একটাই মাত্র মেহেদি গাছ ছিল। বিকেলেই পাতা ছিড়ে মেহেদি বাটতে বসে যেতেন বড় আপুরা সবাই। নারকেল পাতার শলা দিয়ে হাতে মেহেদি লাগাতাম। বাড়িজুড়ে এক ঝাঁক ছেলে-মেয়ে মেহেদি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সুন্দর দৃশ্যের দেখা পাওয়া কঠিন।
তখন ঈদ ছিল শীতকালে। রাতে লাগিয়ে রাখা মেহেদির ঘ্রাণে সকালে ঘুম ভাঙতো। মনে হতো এটাই যেন ঈদের ঘ্রাণ! ফজরের নামাজের পর কনকনে শীতের মধ্যে সুগন্ধি সাবান মেখে গোসল করতাম। গোসল শেষে নতুন জামা পরে ঈদ সেলামি নেয়ার জন্য চলে যেতাম দাদার কাছে। দাদা আগে থেকেই কড়কড়ে নতুন দশ টাকার নোট রেডি করে রাখতেন। যাওয়ামাত্রই মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে দিয়ে নোটটা। এরপর একে একে চাচা আর জেঠাদের থেকে আদায় করতাম ঈদ সালামি। মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই খেয়ে দাদার হাত ধরে চলে যেতাম ঈদের নামাজ পড়তে।
ঈদের দিনে ঈদগাহের পাশে সার বেঁধে খেলনার দোকান বসতো। আমাদের বয়সী গ্রামের ছেলেরা আগের দিন বাঁশের কঞ্চি, নারিকেল পাতা, সুপারি পাতা দিয়ে দোকান বানাতো। ১০০-২০০ টাকার পুঁজির সে ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের দোকানে চকলেট, চানাচুর, বাদাম, আচার, খেলনা গাড়ি, বেলুন, বাঁশি ইত্যাদি নানা রকমারি সামগ্রী পাওয়া যেতো। অনেকে আবার বাড়িতে বনাতো চালতার আচার, আমড়ার আচার, আলুর দম বানিয়ে দোকানে বিক্রি করতো। পাড়ার ছেলেদের মধ্যে ঈদের এ বেচাবিক্রি ছিল খুব আনন্দের ব্যাপার।
আমাদের ঈদ আনন্দের বড় অনুষঙ্গ ছিল বিটিভির ঈদ অনুষ্ঠান। বাড়িতে মাত্র কয়েক ঘরে টেলিভিশন ছিল। মা-খালারা আর আমরা ছোটরা একসাথে বসে যেতাম টেলিভিশনের পর্দার সামনে। ঈদে সকাল থেকেই টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা ও দুপুরে সিনেমা চলতো। দুপুরের সিনেমার প্রতি বিশেষ ঝোঁক থাকতো সবার, সিনেমা বা অনুষ্ঠান শেষ না করে কেউ যেন উঠতে চাইতো না।
সন্ধ্যায় মাগরিবের আযান দিলে মনে হতো ঈদ বুঝি শেষ হয়ে এলো৷ মন খারাপ হয়ে যেত কিছুটা। ধীরে ধীরে ঈদের ছুটি ফুরিয়ে আসতো। ঢাকায় ফেরার দিন ঘনিয়ে এলে সব হারিয়ে ফেলার মত অনুভূতি হতো। আজও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে আদরমাখা কন্ঠে নানী বলছেন- ভাইরে, আবার কবে আসবি?
লেখক, নোমান বিন হারুন
শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।