ভারতের লোকসভা নির্বাচন ২০২৪: সরকার খুশ, বিরোধী দল ভি খুশ
- ড. মো. আনোয়ারুল কবির
- প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২৪, ০২:৫৯ PM , আপডেট: ০৭ জুন ২০২৪, ০৩:১২ PM
গত দুবারের মত গদিনশিন বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তারা লোকসভার ৫৪৩ টি আসনের মধ্যে ২৪০ টি আসনে এগিয়ে আছে। জোটগতভাবে, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ ২৯২ টি আসনে এগিয়ে রয়েছে। কেন্দ্রে সরকার গঠনের জন্য দরকার ২৭২ টি আসন।
অন্যদিকে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন I.N.D.I.A. জোট আশাতীত ভালো ফলাফল করেছে। জোটটি ২৩৫ টি আসনে এগিয়ে রয়েছে। জোটের প্রধান দল কংগ্রেস পেয়েছে নিরানব্বইটি আসন। জোটের অন্যান্য শরীকদের মধ্যে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি পাচ্ছে ৩৪ টি আসন, পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ২৯টি আসন, ও দক্ষিণী রাজ্য তামিলনাডুর ডিএমকে পেতে যাচ্ছে ২২টি আসন।
এবারের নির্বাচনের বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করলেও বিজেপি জোটের শরীকদল চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টি (১৬ আসন) ও নিতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড (১৪টি আসন) এর সমর্থনে নরেন্দ্র মোদী পর পর তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার সামলাবেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর পর নরেন্দ্র মোদী পরপর তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হবার গৌরব অর্জন করলেন।
এবারের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে ভারতের জনগণ শর্তসাপেক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর উপরই আস্থা রেখেছে। এ নির্বাচনে বিরোধী দলের পক্ষ হতে প্রধানমন্ত্রী পদে কারো নাম ঘোষণা করা হয়নি। নির্বাচনের ফল বলছে, বিরোধী জোটের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদীর বিপরীতে কোন শক্তিশালী প্রার্থী নেই। গত দুবারের নির্বাচনে বিজেপি ভূমিধস বিজয় অর্জন করে এককভাবে সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করেছিল। তবে এবারের ম্যান্ডেট বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীকে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে সরকার চালানোর ব্ল্যাঙ্ক চেক দেয়নি। এবার সরকার চালানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে শরীক দলগুলোকে আস্থায় রাখতে হবে।
এই নির্বাচনী ফলাফলে বিরোধী জোটের খুশী হবার কারণ রয়েছে। বিগত দুই লোকসভা নির্বাচনে অপজিশন পার্টি এমন গো হারা হেরেছিলো যে কোন বিরোধী দল লোকসভার মোট আসনের এক-দশমাংশ আসন হাসিল করতে পারেনি। তাই গত দুই লোকসভায় বিরোধী দলের নেতার আসন শূন্য ছিল। এবার লোকসভার দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেতা অচিরেই নেতা প্রতিপক্ষের আসন অলংকৃত করবেন। এ নির্বাচনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো হিন্দি বলয়ের প্রধানতম রাজ্য উত্তর প্রদেশে বিজেপি বিরোধী জোটের কাছে হেরে গেছে। এ রাজ্যের ৮০ টি আসনের মধ্যে বিরোধী জোট ৪২ আসনে জয়ী হয়েছে। এর মধ্যে সমাজবাদী পার্টি একাই পেয়েছে ৩৪ টি আসন। এই রাজ্যের রায়বেরিলি আসন থেকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সাড়ে চার লাখ ভোটের ব্যবধানে বিজেপির প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছেন। পাশের আসন আমেথিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরাণী গান্ধী পরিবারের অনুগত কিশোরী লাল শর্মার কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। সারাদিন মান রাহুল গান্ধীর গিবত না করে জনগনের সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিলে নিজের আসন বাঁচাতে পারতেন।
“আব কি বার, চারশো পার”- এই নির্বাচনী স্লোগান দিয়ে বিজেপি তার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলো। তা অর্জিত হলে বিজেপি এককভাবে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা পেতো। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছিল। ভারতীয় জনগণের অপরিসীম প্রজ্ঞা তাকে ঠেকিয়ে দিলো। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের জানুয়ারীতে নরেন্দ্র মোদী অযোধ্যায় রাম মন্দিরের প্রাণ প্রতিষ্ঠার পর বিজেপি আশা করেছিলো যে ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্য উত্তর প্রদেশের ৮০ টি আসনের সবগুলো আসন জিতে যাবে। কিন্তু, ঐ রাজ্যে তারা অর্ধেক আসনেও জিততে পারেনি। তারা খোদ অযোধ্যায় সমাজবাদী দলের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছে।
এবার আমাদের দেশের পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কথা বলি। এই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী চরম শক্তির পরিচয় দিয়ে তাঁর দুর্গ রক্ষা করেছেন। রাজ্যের ৪২ টি আসনের ২৯ টি আসন তাঁর থলেতে ভরেছেন। এই রাজ্যে বিজেপির ১৮টি আসন কমে ১২ তে নেমেছে। মালদহ, মুর্শিদাবাদ জেলায় কংগ্রেস তার দুর্গ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এই রাজ্যে জুটেছে মোটে একটি আসন।
এবার একটি জোটের অসফল পরিণামের কথা লিখতে হয়। একে বরং শোকগাঁথা বলাই ভাল। এই জোটটি হলো বামফ্রন্ট যার নেতৃত্বে রয়েছে সিপিএম। এই বিরোধী দলটি প্রথম ১৯৫৭ সালে কেরালা রাজ্যে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে। নম্রুদিপাদ হন বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত কমিউনিস্ট রাজ্য শাসক। এই ফ্রন্টের নেতা জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটানা ৩৪ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছিলো। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজদণ্ড দীর্ঘদিন তাদের হাতে ছিল। ২০০৪ এ গঠিত প্রথম ইউপিএ সরকারে পঞ্চাশের বেশী আসন নিয়ে তারা ছিল কংগ্রেসের প্রধান শরিক। এবারের নির্বাচনে তারা সমূলে উৎপাটিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় এবার তাদের কোনো আসন নেই। কেরালায় একটি আসনে জিতে লোকসভায় কোনোমতে তাদের একজন প্রতিনিধি পাঠাতে পেরেছে।
রাজনীতি বড়ই বিচিত্র। এতে কে কবে কার শয্যাসঙ্গী হয়, তা বলা মুশকিল। গতবারের লোকসভা নির্বাচনে অন্ধ্র প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী চল্দ্রবাবু নাইডু বিজেপির প্রতিপক্ষ জোট দাঁড় করার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। এবার ভোল পাল্টে তিনিই হয়েছেন বিজেপি জোটের সবচেয়ে বড় শরিক। বিহারের নিতীশ কুমারও কম ভেলকি দেখাননি। বছরখানেক আগে ইন্ডিয়া জোট গঠনের প্রধান কুশীলব ছিলেন তিনি। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। রাজনৈতিক আবহাওয়া বিশারদ নিতীশ কুমারের নজর ছিলো প্রধানমন্ত্রীর কুরসীর দিকে। যেই প্রতিভাত হলো মমতাদি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করবেন না, সেই ১৮০ ডিগ্রি পল্টি দিয়ে শামিল হলেন এনডিএ শিবিরে।
এই নির্বাচনী ফলাফল ভারতের গণতন্ত্রের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে। ভারত প্রজাতন্ত্রে রূপ নেয়ার পর ১৯৫২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত যতগুলো লোকসভার নির্বাচন হয়েছে, সেই নির্বাচনগুলোর মধ্যে ১৯৭৭ সালের নির্বাচন ছাড়া বাকী নির্বাচনগুলোতে কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলো। ঐ দীর্ঘসময়ের শাসনকালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বিরোধী দলকে আস্থায় নিয়ে দেশ চালালেও তাঁরই কন্যা ইন্দিরা গান্ধী কদাচিৎই বিরোধী দলকে পাত্তা দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে তাঁর ঋণ স্বীকার করেই বলতে চাই, নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য তিনি ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমদকে দিয়ে ইমার্জেন্সি শাসন জারি করিয়ে সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজী দেশাই, অটল বিহারী বাজপেয়ী সহ হাজারো বিরোধী নেতাদের জেলে পুরেছিলেন। ১৯৭৭ সালের ইলেকশনে তাঁকে তার খেসারত দিতে হয়েছিল। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে এলেও সেই কংগ্রেস আর নেহেরুর উদারবাদী কংগ্রেস রইলোনা। তাঁর শেষ মেয়াদে তিনি পূর্ব পাঞ্জাব এর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শায়েস্তা করতে স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালালেন। খুন হলো ভিদ্রানওয়ালে। ১৯৮৪ সালের অক্টোবরে তিনি তাঁর শিখ দেহরক্ষীদের হাতে খুন হলেন। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর পুত্র রাজীব গান্ধী জনগণের প্রবল সহানুভূতি নিয়ে ৪১৪ আসনে জিতে ক্ষমতায় এলেন। রাজনীতিতে নবীন রাজীব শ্রীলংকার তামিলদের এক হাত দেখে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। শ্রীলংকায় বিফল হয়ে দেশে ফেরত এলো ভারতীয় বাহিনী। ১৯৯১ সালে শ্রীপেরুমবুদুরে তামিল সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়ে তিনি ভুল সিদ্ধান্তের মূল্য দিলেন।
এরপর থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস আর কখনো এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ১৯৯১ সালে নরসীমা রাও একবার ও ২০০৪ সালে ড. মননোহন সিং দুই মেয়াদে সফলভাবে কোয়ালিশন সরকার চালিয়েছেন। এই দুই কৃতবিদ্য প্রধানমন্ত্রীর মাঝামাঝি সময়ে বিজেপি দলের প্রতিষ্ঠাতা অটল বিহারী বাজপেয়ী ছয় বছর এনডিএ গঠন করে কোয়ালিশন সরকার চালিয়েছেন। এঁরা তিনজনই শরিক দলগুলোর সাথে কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম ঠিক করে সে অনুযায়ী সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছিলেন। ফলে সরকার তিনটি ছিলো বেশ ব্যালেন্সড। “আইডিয়া অব ইন্ডিয়া” এর উপর ভিত্তি করে যে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৫০ সালে, ভীম রাও আম্বেদকরের সংবিধানের ভিত্তিতে। তার মূল কথা ছিলো “বৈচিত্র্য অষুন্ন রেখে একতাবদ্ধ হও (Unity through diversity)"।কোয়ালিশন সরকারগুলো তা রক্ষায় সবঢেয়ে বেশী সচেষ্ট হয়েছে।
সেই অর্থে কোন দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া শাপে বর হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বিজেপির সদরদপ্তর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণে তার প্রতিফলন দেখা দিলো। কর্মীদের এনডিএ জোটের বিজয় সাড়ম্বরে উদযাপন করার কথা বললেও এবার বিরোধী দলগুলোর কঠোর সমালোচনা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সুযোগ পেলেই তিনি “পাপ্পু” বলে কটাক্ষ করতে ভুলতেন না। এবার তিনি তা বেমালুম ভুলে গেলেন। এটি একজন পরিণত রাজনীতিবিদের লক্ষণ বটে।
লেখক: অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক উপাচার্য, স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ।