শিক্ষকতা পেশায় চাই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা
দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার পুরো বিশ্বে দখল করেছে শীর্ষস্থান। এমনকি প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে আরম্ভ করে অধস্তন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ এর সাথে জড়িত। বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতি যেন নিত্যদিনের ব্যাপার। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের এ-ধরনের দুর্নীতির পেছনে নিরক্ষর নন, বরং যারা প্রচলিত শিক্ষাধারায় শিক্ষিত তাদের দিকেই সবসময় অভিযোগের তীরটি আসে। প্রচলিত শিক্ষায় যারা শিক্ষিত, তারাও নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সময়ের শিক্ষার্থী। সেখান থেকে বেশ দীর্ঘদিন ধরে একটি আলোচনা বিভিন্ন মহলে বেশ জমজমাট— সেটি হলো, দেশের এত দুর্নীতির দায় কার? শিক্ষক কি তাঁর শিক্ষার্থীর অন্যায়ের দায় এড়াতে পারেন?
বলা হয়ে থাকে, শিক্ষক সমাজ যদি তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার পরিপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারতেন, তাহলেই কিন্তু দেশের দুর্নীতি, অনাচার উল্লেখযোগ্যহারে কমে যেতো। কিন্তু, দুর্নীতির পেছনের মূল জায়গাগুলোকে কী আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি? উত্তর হচ্ছে, ‘না’! শিক্ষককে সরাসরি তার নিজের শিক্ষার্থীদের দুর্নীতির দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর পূর্বে বেশকিছু আলোচনা জরুরি।
সাম্প্রতিককালে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই এসব নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করেন অনেকটা এভাবে যে - “দেশের লোকজন যে খারাপ, দুর্নীতিবাজ হইয়া উঠে, এতে শিক্ষকদের কি দায় নাই? ছাত্র বড় হইয়া ভালো করলে শিক্ষক যদি কৃতিত্ব নেয়, তাহলে খারাপ ছাত্রদের দোষের দায় কেন তাদের উপর কিছুটাও বর্তাবে না?”
আপাতদৃষ্টিতে এই ভাবনায় বিশেষ কোনো সমস্যা না থাকলেও এটা ভাবনাটি মূলত অদূরদর্শী। কারণ, কোনো একজন শিক্ষকের শিক্ষার্থী যখন সমাজের তথাকথিত সম্মান-মর্যাদার নিরিখে বড় পর্যায়ে পৌঁছে যান, তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষক তাঁকে নিজের শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। কিন্তু, কোনো শিক্ষকের শিক্ষার্থী যখন চুরির দায়ে কিংবা অপকর্মের দায়ে দণ্ডিত হন, তখন কি সেই দায়ের ভাগীদার শিক্ষকেরও হওয়া উচিত নয়? আর সেক্ষেত্রে শিক্ষকের কি সত্যি তখন বলা উচিত যে, আমার শিক্ষার্থীই এগুলো করেছে! এ দায় আমারও? সফলতা আর নৈতিকতা কি সমার্থক? শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের শিক্ষকসমাজের উদাসীনতা এই ব্যাপারে প্রকট হয়ে যাচ্ছে। যার প্রতিফলন আমাদের চোখে দৃশ্যমান। জাতির কারিগর শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে, শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষার সুযোগ তৈরি করবে “উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা”। শিক্ষার ইতিহাস অনুসরণ করলে আমরা তিনটি ধারা আমরা দেখতে পাই: আনুষ্ঠানিক শিক্ষা (formal education) , অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা (Informal education) এবং উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা (non-formal education) “উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা” বলতে বোঝায়, অনানুষ্ঠানিক এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাঝামাঝি অবস্থান অর্থাৎ 'No Man’s Land', যেখানে একটি ভারসাম্য থাকবে শিক্ষার্থী দলের জন্য। এটি একটি উন্মুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা।
সমাজের যেকোনো শ্রেণি-পেশার লোকই এতে শামিল হতে পারেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। এতে সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাক্রম থাকেনা। আর তাই তা অত্যন্ত শিথিলযোগ্য। এটি কোনো সনদভিত্তিক শিক্ষাও না। পেশাগত কাজে দক্ষতা অর্জনই এর মূল লক্ষ্য। সেই সাথে ব্যবহারিক শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে পরিচালিত হয় এ শিক্ষা, তাই কোনো নির্দিষ্ট স্থান কালে এটি সীমাবদ্ধ না।আমাদের দেশ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ধারণা নতুন কিছু নয়। নব্বই দশক থেকে এর গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বিভিন্ন কারণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত হয় দেশের বিরাট এক জনগোষ্ঠী। প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে পারেনা দেশের অনেক শিশু। মাধ্যমিকে এই হার আরো কম। শিক্ষায় ঝড়ে পড়ার হার আমাদের অনেক বেশি। দক্ষিণ এশিয়া বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। তাই সরকার উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ করেছে। ২০১৪ সালের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়– “শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সাক্ষরজ্ঞানদান, জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের মানুষকে শিক্ষিত করা জন্য আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করাই এ আইনের মূল লক্ষ্য।
বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক কারণে শুধু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে দেশে শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব না। তাই উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সকল বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী। এজন্য বলা হয়ে থাকে – Non formal education for all, যেখানে পূর্বে প্রচলিত ধারণাকে নতুনভাবে গঠন করা হয়েছে।
আমাদের উন্নয়নশীল দেশে, সমস্যা সবচেয়ে বেশি শিক্ষায়। আমাদের সমাজে এই পরিস্থিতিটা বেশ ভালো বোঝা যায় যদি আপনি কারো কাছে আপনার অসুস্থতা নিয়ে কথা বলেন। তিনি আপনাকে একগাদা ডাক্তারি পরামর্শ দিয়ে দেবেন এবং ঔষদের প্রেসক্রিপশন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করবেন না। আত্মীয়তান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার এই হলো ঐতিহাসিক সমস্যা। আপনজন হিসেবে কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তিনি এইসব পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু ক্ষতির দিকটা তিনি বিবেচনা করছেন না। বুঝতে চাচ্ছেন না যে, ডাক্তার ছাড়া স্বাস্থ্যগত পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার অন্য কেউ রাখেন না। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকলেও এ কাজের জন্য রাষ্ট্র তাদেরকেই প্রস্তুত করেছে এবং অসুখ-বিসুখে তাদের পরামর্শ নেওয়াই আমাদের কর্তব্য।
আমাদের দেশে শিক্ষার পরিস্থিতিটাও তথৈবচ, বলা যায় আরও নাজুক। ডাক্তারি বিদ্যার মতো শিক্ষাও যে একটি বিজ্ঞান এবং এই বিজ্ঞানে একজন শিক্ষক পারদর্শী না হলে কথা বলার, আলোচনা করার, লেখালেখি করার অধিকার তৈরি হয় না- এই বিষয়টি আজও আমরা বুঝতে পারিনি, অনুভব করতে পারিনি।
বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল মনে করেন, ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য বড় মাপের মানুষ তৈরি করা।’ আর এই কাজটি সুনিপুণভাবে করে থাকেন একজন শিক্ষক। শিক্ষক হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। সুতরাং শিক্ষক যদি নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ না হন তাহলে বড় মাপের মানুষ তৈরি করা সম্ভব না। বাট্রার্ন্ড রাসেল মনে করেন, ‘শিক্ষা মানুষকে দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ ঘটিয়ে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।’ শিক্ষা-শিক্ষক, মূল্যবোধ-নৈতিকতা শব্দগুলো একটি অপরটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যারা মানুষকে কল্যাণের শিক্ষা দেয় আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতারা, আসমান ও জমিনের বাসিন্দারা, এমনকি গর্তের পিপীলিকা এবং মাছ তাদের জন্য দোয়া করতে থাকে।’ শিক্ষার সাথে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ খুবই জরুরি। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের এই শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তাদের পেশাগত জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষক নৈতিকতা মূল্যবোধের শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারেন। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক শিখবেন তার প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়াবলি। যেখানে তিনি শিখবেন, একজন আদর্শ শিক্ষক, শিক্ষার্থীর মধ্যে মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো এবং মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার চর্চার মানসিকতা এবং দেশপ্রেম ও সাম্প্রদায়িক সৌহার্দে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করে ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুনাগরিক তৈরি করা। সৃজনশীল চিন্তাধারার বিকাশ ঘটিয়ে জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-কষ্ঠির প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করা। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘একজন ব্যক্তির জীবন নির্ভর করছে আত্মাও দেহের সম্পর্কের ওপর, আর একটি জাতির জীবন নির্ভর করছে তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর। আত্মার জীবন প্রভাব বন্ধ হলে ব্যক্তির জীবন প্রবাহ হয় মৃত। জাতি মৃত্যুবরণ করে যদি তার আদর্শ হয় পদদলিত।’
শিক্ষক বাস্তব জীবনের ভালো দিকগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করে আদর্শ ও মূল্যবোধের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবেন। শিক্ষকদের কথায় ও কাজে মিল থাকতে হবে এবং আদর্শ বাস্তবায়নে কুশলী ও সাহসী হতে হবে। শিক্ষকের থাকতে হবে জ্ঞানের গভীরতা ও নির্ভুলতা, ব্যক্তিত্ববোধ, বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও সহজ-সাবলীল ও আকর্ষণীয় প্রকাশভঙ্গি, আচার-আচরণে সংযত ও কৌশলী। নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে তিনি থাকবেন নিরপেক্ষ ও কঠোর। শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের থাকবে গভীর মমত্ববোধ ও দায়িত্ববোধ এবং অভিভাবক হিসেবে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করবেন যেন শিক্ষার্থী তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। তিনি শ্রেণিকক্ষে তার শিক্ষার্থীদের মাঝে “Culture of Silence” কে ভেঙে দিতে শেখাবেন। শিক্ষার্থীদের আপন করে নিয়ে একটি অভিনব সমাজ বিনির্মাণে কার্যকরী ভূমিকা রাখবেন। নীতির ক্ষেত্রে অনমনীয় হতে শেখাবেন। তিনি শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি নিরপেক্ষ থাকবেন ও সুবিচার করবেন। শিক্ষক হবেন নীতি ও বিচক্ষণতাবোধ সম্পন্ন মানুষ, যিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি বোধ জাগিয়ে তুলবেন, যেখানে তার শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার স্খলন কখনো না হয়। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এভাবেই শিক্ষকতা পেশাকে অধিকতর উচ্চতায় নিয়ে যাবে একদিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।