কোষে একই ডিএনএ থাকলেও অঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন কেন?
ডিএনএ নিউক্লিয়াসের এমন একটি অংশ যেটি আমাদেরকে একে-অপর থেকে পৃথক করেছে। একটা জীবের চোখ, নাক, কান, চেহারা ইত্যাদি কেমন হবে এর পেসক্রিপশন আসে ডিএনএ থেকে। আমাদের দেহের সমগ্র কাজের প্রোগ্রামিং ডাটা সংরক্ষিত থাকে ডিএনএ-তে। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত আমাদের দেহের প্রতিটি কোষেই ডিএনএ থাকে।
দেহের কোষগুলোর ডিএনএগুলোকে একটির পর একটি রাখা হলে এর দূরত্ব এত বেশি হবে যে এটি দ্বারা চাঁদে ৮ বার যাওয়া-আসা করা যাবে। ডিএনএ এর তথ্যগুলো এডিনিন, থায়ামিন, গুয়ানিন ও সাইটোসিন ক্ষারক দ্বারা লিখিত। প্রতিটি ডিএনএ-তে এত পরিমাণ তথ্য থাকে যে যদি এর ক্ষারকগুলোর নামের প্রথম অক্ষর A, T, G, C নিয়ে এদের দ্বারা বহনকৃত তথ্য একটি বই এ লিপিবদ্ধ করা হয় এবং বইয়ের পেইজগুলো যদি স্ট্যান্ডার্ড টাইপের হয় তাহলে বইটির উচ্চতা প্রায় আইফেল টাওয়ারের (৩২৪ মিটার) সমান হবে এবং স্ট্যাচু অব লিবার্টির (৯৩ মিটার) উচ্চতার দ্বিগুণেরও বেশি হবে।
একজন ব্যক্তি খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম বাদে যদি একটানা ডিএনএ’র তথ্যগুলোকে A,T,G,C এর মাধ্যমে কম্পিউটারে প্রতি মিনিটে ৪০ অক্ষর হারে টাইপ করতে থাকে তাহলে মানব ডিএনএ’র সকল তথ্য টাইপ করতে তার সময় লাগবে প্রায় ৬৫৫ দিন। নিশ্চয় এ থেকেই আমরা বুঝে গেছি ডিএনএ তে কী পরিমাণ তথ্য থাকে। আরও মজার বিষয় হলো আমরা জেনেছি একটা জীবের চোখ কেমন হবে, কান কেমন হবে, চেহারা কেমন হবে এগুলোর পেসক্রিপশন আসে ডিএন থেকে। যেহেতু একটি প্রাণীর সব অঙ্গের কোষে একই তথ্যসমৃদ্ধ ডিএনএ থাকে তাহলে তো সব অঙ্গ একই রকম হওয়ার কথা ছিল। একই ডিএনএ সমৃদ্ধ হওয়ার পরও চোখ এক ধরনের, কান আরেক ধরনে, ঠোঁট আরেক ধরনের হয় কেন?
মনে করুন, একটি রেস্টুরেন্টে বিশাল একটি রেসিপি বই আছে যেখানে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরির নির্দেশাবলি আছে।এখন বলুন, ঐ রেস্টুরেন্টে শেফ রেসিপি বই থেকে একসঙ্গে সব ধরনের রেসিপি রান্না করে ফেলবে? নাকি যখন যে রেসিপি প্রয়োজন তখন সে রেসিপি রান্না করবে? নিশ্চয় যখন যে রেসিপি প্রয়োজন তখন সে রেসিপি তিনি রেসিপি বইয়ের গাইডলাইন অনুসারে রান্না করবেন। রেসিপি বই এ সব ধরনের রেসিপি থাকলেও শেফ সকালে এক ধরনের রেসিপি তৈরি করেন বিকেলে আরেক ধরনের, গ্রীষ্মে এক ধরনের রেসিপি তৈরি করেন, শীতে আরেক ধরনের।
তেমনি ডিএনএকে যদি রেসিপি বইয়ের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে প্রোটিন হবে রেসিপি। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ তৈরি এবং পরিচালিত হয় ডিএনএ নামক রেসিপি বইয়ের গাইডলাইন অনুযায়ী প্রোটিন নামক রেসিপি তৈরির দ্বারা। ডিএনএ নামক রেসিপি বই এ সব ধরনের প্রোটিন নামক রেসিপি তৈরি হওয়ার নির্দেশিকা থাকলেও রাইবোজোম নামক শেফ সব অঙ্গে সব প্রোটিন তৈরি করে না বরং যে অঙ্গে যে প্রোটিন প্রয়োজন ডিএনএ এর গাইডলাইন অনুযায়ী সে প্রোটিন তৈরি করে। যার দরুন সব কোষে একই ডিএনএ থাকার পরও চোখের গঠন ও কাজ ত্বক, চুল, ও নাকের গঠন ও কাজের মতো হয় না। এই আশ্চর্যজনক প্রক্রিয়াটিই অবিশ্বাস্যভাবে কোষগুলোকে বৈচিত্র্যময় করে তুলে।
ডিএনএ নামক রেসিপি বই কয়েক পৃষ্ঠার একটা রেসিপি বই নয়! এত তথ্য সমৃদ্ধ রেসিপি বইটি কতটুকু বড় জানেন? এত তথ্যসমৃদ্ধ বইটি প্রকৃতকোষে মাত্র ১সেমি. লম্বা। ডিএনএ এর তুলনায় কোষ আরও অনেক ছোট। ডিএনএ এর দৈর্ঘ্য একটি কোষের দৈর্ঘ্য চেয়ে প্রায় ২ হাজার গুণ বড়। আমরা জানি কোষের ভেতরে ডিএনএ থাকে তাও সম্পূর্ণ কোষ নয়! কোষের নিউক্লিয়াস হলো তাদের আবাসভূমি। তাদের জন্য নির্ধারিত আবাসভূমির দৈর্ঘ্য হলো ৫ মাইক্রোমিটার। এ হিসেবে তাদেরকে যেভাবেই হোক ১ সেমি. থেকে ৫ মাইক্রোমিটার দৈর্ঘ্যের হতে হবে অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার গুণ ছোট হতে হবে। এত ছোট্ট একটা জায়গায় এত বিশাল তথ্যের সমাহার চিন্তা করা যায়!
ঘুড়ি উড়ানোর লম্বা সুতো যেমন নাটাইয়ে পেঁচিয়ে ছোট একটা জায়গায় আবদ্ধ করা হয় এবং প্রয়োজন হলে নাটাই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লম্বা সুতো বের করা হয় আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে এলে সুতো গুটিয়ে ফেলা হয় তেমনি ডিএনএ কেও কোষে অবস্থান করতে হলে একটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছোট হয়ে আসতে হয় এবং যখন প্রোটিন তৈরির নির্দেশিকা দেওয়া লাগে তখন সংশ্লিষ্ট নির্দেশিকার অংশটি ঐ প্যাক থেকে মুক্ত হয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রোটিন তৈরি হয় এখানে ২টা প্রক্রিয়া জড়িত, ট্রান্সক্রিপশন ও ট্রান্সলেশন।
একেকটা কোষে বিভিন্ন রকমের প্রায় ৩৫,০০০ প্রোটিন বিভিন্ন রকমের ফাংশনের জন্য তৈরি হয়। ডিএনএ যদি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় প্যাক হয়ে থাকে তাহলে রেসিপি গাইডলাইন সঠিকভাবে ফলো করা সম্ভব হবে না ফলে সঠিক প্রোটিন তৈরি হবে না ফলস্বরূপ, কোষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই, ডিএনএ কে কোষে সুবিন্যস্তভাবে ৫০ হাজার গুণ ছোট হয়ে অবস্থান করতে হবে। প্রকৃতকোষী ও অপ্রকৃতকোষী জীবে ডিএনএ প্যাকেজিং প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কারণ, প্রকৃতকোষী জীবের ডিএনএ লম্বাটে আর অপ্রকৃতকোষী জীবের ডিএনএ গোলাকার। যেহেতু মানুষ প্রকৃত কোষীপ্রাণী তাই আমাদের এই আলোচনায় আমরা প্রকৃতকোষী জীবের ডিএনএ প্যাকেজিং সম্পর্কে জানবো।
ডিএনএ নাইট্রোজেন গঠিত চার ধরনের ক্ষারক- এডিনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন, থায়ামিন ও ডিঅক্সিরাইবোজ নামক কার্বোহাইড্রেট এবং ফসফেট দ্বারা গঠিত।ফসফেট থাকার কারণে ডিএনএ নেগেটিভ চার্জযুক্ত। নেগেটিভ চার্জের ডিএনএ হিস্টোন নামক পজেটিভ চার্জের এক ধরনের প্রোটিনকে কেন্দ্র করে পেঁচিয়ে নিজেকে ছোট করে আনে।
ডিএনএ প্যাঁচানোর জন্য মোট পাঁচ ধরনের ৯টি হিস্টোন প্রোটিন একটা স্ট্রাকচার গঠন করে যাকে নিউক্লিওসোম বলা হয়।হিস্টোন প্রোটিন নিজেদের মধ্যে জড়িয়ে ডিএনএ-কে এদের উপরে পেঁচানোর জায়গা তৈরি করে দেয়। প্রতিটা নিউক্লিওসোমে ডিএনএ দুইটি প্যাঁচ দিয়ে( প্রতি প্যাঁচে ৮০ বেস পেয়ার পরিমাণ ডিএনএ থাকে) পরের নিউক্লিওসোমে আবার ২টি প্যাঁচ দেয় এভাবে নিউক্লিওসোমের একটি চেইন তৈরি হয় এই গঠনকে string with beads বলে।
পেঁচানোর ফলে string with beads এ ডিএনএ এর আকার অনেকটা ছোট হয়ে আসে। পরপর ছয়টি নিউক্লিওসোম আবার নিজেদের মধ্যে পেঁচিয়ে ছোট হয়ে আসে একে ৩০ ন্যানোমিটার ফাইবার বলা হয়। এই ৩০ ন্যানোমিটার ফাইবার আবার একটা প্রোটিন স্কাফোল্ডে পেঁচিয়ে ডিএনএ এর সাইজ আরও ছোট করে আনে, এ অবস্থাকে লোপ বলে। এভাবে ঘনীভূত ডিএনএ সম্পূর্ণ সম্প্রসারিত ডিএনএ থেকে ৫০ হাজার গুণ ছোট হয়ে আসে, ডিএনএ এর এই অবস্থাকে ক্রোমোজোমাল ফর্ম বলে।
ঘনীভূত অবস্থায় সাধারণত ডিএনএ থেকে প্রোটিন তৈরি হতে পারে না। ডিএনএ এর গাইডলাইন অনুযায়ী আরএনএ তৈরির মধ্যে দিয়ে প্রোটিন তৈরি হতে হলে ডিএনএ কে প্যাক অবস্থা থেকে অবমুক্ত হতে হয়। যে প্রোটিন তৈরির রেসিপি প্রয়োজন ঐ রেসিপিটা গোটানো রেসিপি বই থেকে উন্মুক্ত হয় এবং নির্দিষ্ট রেসিপির প্রোটিন তৈরি হয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ (বিজিই), মাভাবিপ্রবি।