সাম্য ও সম্প্রীতির ঈদ
দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর বছরের জরা-ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। রমজানের শুরু থেকেই এই পবিত্র দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে মুসলিম বিশ্ব। ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পথের ক্লেশ অগ্রাহ্য করে সবাই ছুটে আসে আপন নীড়ে। আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির পরিমণ্ডল পেরিয়ে ঈদ বয়ে নিয়ে আসে সামগ্রিক কল্যাণ। জীর্ণ পাপ-পঙ্কিল জীবনকে পরিশুদ্ধ করতে শুদ্ধতার প্রতীকরূপে ঈদ আসে নবজীবনের অঙ্গীকার নিয়ে। সকল বৈরিতা-শত্রুতাকে পাশকাটিয়ে মিলনের মহোৎসবে হৃদয়যোগের পয়গাম নিয়ে ঈদ আসে ধূলিধূসর পৃথিবীকে সম্প্রীতির বন্ধনে জড়িয়ে নিতে।
দীর্ঘ রমজানের পর মেঘ ঠেলে শাওয়ালের যে চাঁদ ওঠে, তা হয়তো শিশুর হাসির মতো নির্মল। শিশুর ঠোঁট থেকে যেমন নির্মল হাসি ঝরে পড়ে, তেমনি শাওয়ালের নতুন চাঁদ থেকে ঝরে পড়ে আনন্দধারা। সেই আনন্দ-আলোয় ভরে যায় চারপাশ। আন্দোলিত করে মানবমন। পবিত্র রমজানের শেষে পশ্চিমাকাশে যখন নতুন ‘আল-হেলাল’ দেখা যায়, তখন বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে যে আনন্দ-উন্মাদনা-উচ্ছ্বাস জেগে ওঠে, তাঁদের মনের সেই ভাব প্রকাশ করে নজরুল তাঁর প্রথম ইসলামি সংগীত রচনা করলেন- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ’।
ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে টিভি চ্যানেলসমূহ ও বেতারে একসাথে যন্ত্র সহযোগে এই সংগীত যখন বেজে ওঠে, তখন ঈদের আনন্দ, জোশ হাজারগুন বেড়ে যায়। আবাল-বৃদ্ধ বনিতা সবার মনে এক অনন্য পুলক জাগে। নজরুলের এই গান ছাড়া বোধ ঈদকে রঙিন মনে হয় না। ঈদের আনন্দের পূর্ণতা আসে না। নজরুল এই গানের মাঝেও যে দর্শন রেখে গেছেন, তা আমাদের ভেবে দেখার ফুরসত মেলে না। ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিকতায় নয়, ইসলাম সাম্যে-সম্প্রীতিতে-শান্তিতে-মানবিকতায় সমুজ্জ্বল। তাই ইসলামের অন্যতম উৎসব ঈদের প্রকৃত আনন্দ নিহিত সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমান অংশগ্রহণে।
শ্রেণিগত ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে পোড় খাওয়া সাধারণ মানুষের ঈদ আর দৌলতবান মানুষের ঈদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। ইসলাম মানুষে মানুষে ভেদ মানে না বলে ধনীর সম্পদে সর্বহারাদের অধিকার দিয়েছে। তাই ধনীর ধনে গরিবের হক রয়েছে। এসব দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোই ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য। সমাজে এসব দুঃখী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমেই প্রকৃত ঈদের আনন্দ পাওয়া যাবে। প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামও আজীবন এমন বিভেদহীন সমাজের প্রত্যাশা করেছেন। কবি আসমানী তাগিদের কথা স্মরণ করিয়ে অর্থাৎ নিজেকে মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর কবিতায়, গানে তা স্পষ্ট। কবি বলেছেন–
"যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী,
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ"
কবির ভাবনার মতো আমরা সবাই যদি এগিয়ে আসতে পারি, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সম্প্রীতি ছড়িয়ে দিয়ে পারি তবেই ঈদের খুশি পূর্ণতা পাবে।
সময়ের আবর্তে বিচিত্র জীবনপ্রণালী সৃষ্টি হয়েছে। পরিবর্তনের ফলস্বরূপ সকলের মাঝে দুরত্ব বেড়েছে। মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় থাকায় আমাদের আবেগ-অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। মানবিক সম্পর্ক হালকা হতে হতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। স্বার্থকেন্দ্রিকতা এই দুরত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রমজানের সংযম, ত্যাগ তিতিক্ষা, বদান্যতা ও মহানুভবতার গতিধারার প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রাখার শপথ গ্রহণের দিন ঈদুল ফিতর।
তাই ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে সকল বিভেদ-বৈষম্য, দুরত্ব ভুলে যদি একে অপরকে সৌহার্দ-সম্প্রীতির বন্ধনে না বাঁধতে পারি, তবে ঈদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হারাবে। রমজান যে চিত্তশুদ্ধির পথ বাতলে দিয়েছে তা গ্রহণ করে সমস্ত হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সাম্য ও সংহতির সমাজ প্রতিষ্ঠাই হোক আমাদের ঈদুল ফিতরের অঙ্গীকার। সকলের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক ঈদের সওগাত। আলিঙ্গনের মাধ্যমে বিস্তৃত হোক পরস্পরের সৌহৃদ্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।