ফিরে দেখা ঈদ স্মৃতিতে সুন্দরবন ভ্রমণ
প্রযুক্তির বিকাশ আর বিশ্বায়নের উপর্যুপরি ধাক্কায় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সময়। জীবনের ডায়েরি খুলে পাতা উল্টালেই সময়ের এই বিবর্তনের চিত্র চোখে ধরা দেয়। আমাদের বেড়ে উঠার পরতে পরতে কিছু স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যা আজও অমলিন।
ভিন্ন স্বাদের কিছু গল্প নিয়ে প্রতিবছর ঈদ আসে আমাদের জীবনে। ঈদ বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের সর্ববৃহৎ উৎসব। প্রতিবছর আমাদের মাঝে ঈদ আসে একরাশ খুশির কারণ হয়ে। আনন্দ ভাগাভাগির মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধব পরিবার পরিজন নিয়ে পালিত হয় পবিত্র ঈদ। তবে সময়ের বিবর্তনে আমাদের জীবনে আসে নানা ভাঙ্গা-গড়া। পরিবর্তনের হাওয়ায় উৎসব উদযাপনের আমেজও বদলে যায়। আজকের শহরের জীবনের ঈদ থেকে পুরনো দিনের গ্রামীণ জীবনের ঈদের রং রূপ ছিল আলাদা।
তখনকার দিন ঈদের সময় আমাদের বাড়িতে সাজসাজ রব পড়ে যেতো। নতুন জামা-জুতোর আয়োজনে আমাদের যেতো ঘুম উড়ে। একেক দিন একেকজনের নতুন কাপড়ের সাথে সাথে আমাদের কৌতুহল যেনো বাঁধ ভেঙ্গে যেতো। শহর থেকে চাচা-চাচী, ফুফা-ফুপুর আগমন যেনো সেই আনন্দে যোগ করতো নতুন পালক। কারণ এতে আমাদের সাথে যুক্ত হতো শহুরে কাজিনের দল। ফলে খেলাধুলা আর দুষ্টুমির আয়োজন পরিপূর্ণ হয়ে যেতো বাড়ি।
এরপর রাতে শুরু হতো মেহেদী ডিজাইনের পালা। মেহেদি লাগানোতে পটু বড় বোনেদের পিছে সন্ধ্যা থেকে লাইন দিয়ে একসময় সুযোগ আসতো নিজের। তবে মেহেদির ডিজাইন পছন্দ না হলে সেবারের ঈদটাই কষ্টে যেনো মাটি হয়ে যেতো ।
পরদিন সকালে ফিরনি-সেমাই আর বাহারি পিঠায় শুরু হতো ঈদের সকাল। এরপর গোসল করে সবার থেকে সালামি নিয়ে নানা-মামার সাথে ঈদের মাঠে যেতাম। নামাজ শেষ করে নানা আমাকে নানান রকম খেলনা কিনে দিতেন। এরপর বাসায় এসে সেগুলো নিয়ে বসে যেতাম। একে একে অতিথিরা আসতে শুরু করতেন। সাথে নানান রকম খাবার। সাধারনত আমার ঈদের সকালটা মামা বাড়িতে আর বিকালটা দাদা বাড়িতে কাটে।
তবে সেবারের ঈদটা একটু আলাদা হলো। যাকে বলে সুখে-দুঃখে মিলে একাকার। সময়টা ২০১২ সাল। ঈদের নামাজ শেষে নানার সাথে গিয়েছিলাম নিজ শহর ভ্রমণে। শহরে তো বহুবারই গিয়েছি। কিন্তু এবারে ঈদ-ভ্রমণের সাথে সাথে কাজিনের দলের যোগদান ভিন্ন এক উত্তেজনা যোগ করলো।
বাংলার ইতিহাস-এতিহ্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শনের আমার শহর বাগেরহাট। এখানে রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম ষাট গম্বুজ মসজিদ ও খান জাহান আলীর মাজার। মসজিদটির সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত হলাম। যদিও তখনো স্থাপত্যকলা নিয়ে কোনো ধারণা তৈরি হয়নি, তবে মসজিদের নকশা ও ভেতরকার চমৎকার সৌন্দর্য মনে এক আশ্চর্য মুগ্ধতা তৈরি করলো। মসজিদ থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত মাজার পরিদর্শন করতেও ভুল করলাম না। কালা পাহাড় ও ধলা পাহাড় নামে খান জাহান আলী দীঘিতে বসবাসকারী কুমির দুটিকেও খুব কাছ থেকে দেখতে পেলাম।
সকাল ১০টায় আমরা বাগেরহাট শহরে পৌঁছাই। এরপর একে একে গুরুত্বপূর্ণ দর্শণীয় স্থানগুলো পরিদর্শন করি। তবে এ ভ্রমণের সবচেয়ে স্মৃতিময় সময় তখনো আসেনি। একটু আগেভাগে দুপুরের খাওয়া শেষে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। বিশ্ব ঐতিহ্যের আরেকটি বড় নিদর্শন সুন্দরবনের একটি বৃহৎ অংশই বাগেরহাটে অবস্থিত। তবে সেখানে যেতে আমাদের শহর থেকে বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। সবার আগে যেতে হবে লঞ্চঘাটে।
সেবার যে লঞ্চঘাট থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেটির নাম আজ আর মনে করতে পারি না। তবে সেটি ছিলো পশুর নদীর তীরে অবস্থিত কাঠ-নির্মিত একটি জেটি। সেখান থেকে আমরা একটি ইঞ্জিন-চালিত ট্রলার ভাড়া করি। চুক্তি হলো সুন্দরবনের খালগুলোর ভেতর দিয়ে সন্ধ্যা নামার আগ পর্যন্ত আমরা ট্রলারে ঘুরবো।
ভ্রমণের শুরুতে সব ঠিকঠাকই চলছিলো। মাথায় তখন শুধুই সুন্দরবন দেখার উত্তেজনা। মনে মনে তো বাঘ-ভাল্লুক অনেক কিছুই দেখে ফেললাম। তবে সেই ভাবনায় ছেদ পড়লো পশুর নদীর বিশাল বিশাল ঢেউয়ে। শান্ত নদীটির মাঝামাঝি যেতেই পশুর তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখানো শুরু করে দিলো। ঢেউয়ের তোড়ে নৌকা দুলতে থাকলো। আমরা কয়েকজন নানাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলাম, আর যেসব দোয়া মনে ছিলো সেগুলো পড়তে থাকলাম।
মাঝি আমাদেরকে অভয় দিতে থাকলেন। কিন্তু নৌকার দুলুনির সাথেই আমাদের মনে হতে থাকলো, এই বুঝি উল্টে যাবে এখনই। তবে কিছুক্ষণ পরই ঢেউয়ের প্রকোপ কমে আসলো। সামনে তাকিয়ে দেখলাম আমরা সুন্দরবনে পৌঁছে গিয়েছি। ততক্ষণে পশুর নদী থেকে বের হয়ে সুন্দরবনের শান্ত খালে প্রবেশ করেছি আমরা। সারি সারি গোলপাতা, সুন্দরী আর গেওয়া গাছের মাঝে মাঝেই তখন বানরের লাফালাফি চোখে পড়তে লাগলো।
বাঘের দেখা পাওয়ার জন্য আমরা সবাই উদগ্রীব থাকলেও সে যাত্রায় আর বাঘমামা আমাদের সামনে পড়লো না। তবে মাঝির থেকে বাঘের গাঁ শিউরে ওঠা গল্প শুনলাম। এর মাঝেই হরিণ দেখা থেকে নিরাশ হতে হলো না। একপাল হরিণ আমাদের সামনে থেকেই ছুটে পালালো। তবে ততক্ষণে জোয়ার শেষ হয়ে ভাটার সময় আগত। ভাটা পড়ার আগেই খাল থেকে বের হয়ে আমরা পশুর নদীতে প্রবেশ করি। দুই ঘন্টার এই সুন্দরবন যাত্রায় প্রাণ-প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করলাম।
যখন ফেরার উদ্দেশ্য রওনা হলাম সূর্য ততক্ষণে পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। গোধূলির রক্তিম আভা পশুর নদীর সাথে মিলেমিশে এক অপরূপ সৌন্দর্য জানান দিতে লাগলো। তবে পশুর নদীতে কিছুদূর যেতেই আবারও বাঁধলো বিপত্তি। এবার আমাদের ট্রলারের ইঞ্জিন গেলো নষ্ট হয়ে।
মাঝ নদীতে তখন এক অজানা আশঙ্কায় আমাদের সবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এলা। মাঝি ভাই আমাদেরকে অভয় দিতে লাগলেন যে তিনি এখনই ঠিক করে ফেলবেন। তবে কিছুক্ষণ পর তিনি ব্যর্থ হয়ে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করলেন। ঘাট থেকে ছেড়ে আসা অন্য একটি ট্রলার ডেকে দুটি ট্রলার পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে আমাদেরকে সেটিতে তুলে দিলেন। সেবারের মত আমরা সুন্দরবনের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পশুর নদীর ভয়াবহতা দুটোরই অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
ফেরার পথে নানা আমাকে এক বক্স রংপেন্সিল কিনে দিলেন। আমি বাড়িতে গিয়ে সুন্দরবনের কিছু চিত্র রং পেন্সিলে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলাম। রং পেন্সিলগুলো হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে ফেলেছি নানাকেও। এসবের সাথে সাথে যেনো হারিয়েছে জীবনের রং। শুধু ক্যানভাসে রয়ে গেছে ফিকে হয়ে আসা কিছু স্মৃতি।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।