‘ভুলে যাও ভেদাভেদ হাতে রাখো হাত, ঈদ নিয়ে এলো এক আলোর প্রভাত’
ঈদুল ফিতরের অর্থ হলো, যে আনন্দ বা উৎসব বারবার আসে। সব মুসলমানের জন্যই ঈদের দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব দিক দিয়েই এই দিনটি অনন্য। এর বিশিষ্ট দিক হলো মুসলমানদের প্রতিদিনের সালাত বা নামাজ, সাপ্তাহিক জমায়েত বা জুমার জামাত এবং বার্ষিক পুনর্মিলনী, এই তিনটিই ঈদের মধ্যে দেখা যায়।
ঈদুল ফিতর সারা বিশ্বের মুসলমানের সর্বজনীন উৎসব। নানা প্রতিকূলতা, দুঃখ-বেদনা সব ভুলে ঈদের দিন মানুষ সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হন। ঈদগাহে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে সবাইকে নতুন করে আবদ্ধ করে। ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরে প্রেমের বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হন এবং আনন্দ ভাগাভাগি করেন। মাহে রমজানের এক মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ থেকে মুক্তি পাবার আশায় পবিত্র অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদুল ফিতরের খুশি।
ঈদুল ফিতরে যেমন আছে আনন্দ ও ইবাদত, তেমনি আছে সুসংঘবদ্ধতার মহান শিক্ষাও। এ শিক্ষা রুচিশীল ও মননশীল সংস্কৃতির শিক্ষা। ঈদুল ফিতরের প্রথমেই যে শিক্ষার কথা বলা হয় তা হলো নিয়মানুবর্তিতা। চাঁদ দেখে রমজান মাসের রোজা শুরু থেকে শেষ করা পর্যন্ত যে ধর্মীয় বিধান তা আমাদের নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা দেয়। সঠিক সময়ে ইফতার, সেহরি, ঈদগাহের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়েও সময়ানুবর্তিতার শিক্ষাও পাওয়া যায় এই ঈদ থেকে।
এসবের মাধ্যমে ঈদুল ফিতরে এক উজ্জ্বল ও সুন্দর শৃঙ্খলাবোধের সম্মিলন ঘটে। ইসলামে ঈদের দিন আত্মীয় স্বজনের খোঁজখবর নেওয়ার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের বড় সুযোগ পাওয়া যায় এ ঈদের ছুটিতেই।
রাসুলুল্লাহু (স.) বলেছেন, যে আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে। (সহিহ বুখারি : ৬১৩৮)।
ঈদুল ফিতরের আধ্যাত্মিক ও নৈতিকতা কল্যাণকর বৈশিষ্ট্য অনেক। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
একটি বড় সাফল্যের উদযাপন: আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে ব্যক্তি হিসেবে মুসলিমদের একটি বড় ইবাদতের মাধ্যমে যে অর্জন, তার জন্য সুস্থ ও নির্মল আনন্দ উদযাপিত হয় ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে। এক মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা যাতে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য পানাহার ও যৌনানন্দ থেকে বিরত থাকতে হয়। এটা মুমিন নর-নারীর জন্য সুনির্দিষ্টভাবেই একটি বিরাট সফলতা ও কৃতিত্ব।
শুকরিয়া আদায়ের দিন: ঈদুল ফিতরের দিনটিতে মুসলমানরা ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও আনন্দমুখর পরিবেশে একত্র হয়। তারা সমবেত হয় রাব্বুল আলামীনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা বা শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য। মাহে রমজানে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য যে দায়িত্ব বর্তায়, তা সুচারুরূপে সম্পন্ন হওয়ায় ঈদের দিবসে আল্লাহর প্রতি জ্ঞাপন করা হয় শুকরিয়া। শুধু মুখের কথা কিংবা ধর্মীয় আচার-প্রথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না শুকরগুজারির এই প্রক্রিয়া।
সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং মানবিক উপলব্ধির মধ্য দিয়েও এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। মাসব্যাপী রোজা রাখার পর মুসলমানেরা ঈদের দিনে দরিদ্রের মধ্যে দানখয়রাত করে থাকে। এভাবে আমরা যা দেখি, তা হলো একজন মুসলমান সর্বাধিক আনন্দিত ও সুখী যখন থাকে, তখনো আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। তার গরিব ও অভাবী ভাইবোনকে শুধু স্মরণ নয়, সাহায্যও করে থাকে। ঈদুল ফিতরে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের এই পন্থা আধ্যাত্মিক সাধনা আর মানবিক কল্যাণের চমৎকার সমন্বয় ঘটে।
বিজয় দিবস: ঈদের এই দিন বিজয়েরও। ব্যক্তি হিসেবে একজন মুসলমান যদি তার আধ্যাত্মিক উন্নতি ও বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে, তিনি ঈদকে স্বাগত জানান বিজয়ীর চেতনায়। যিনি বিশ্বস্ততার সাথে রোজার মাসে তার ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেন, সেই বিশ্বাসী ব্যক্তি বা মুমিন ঈদের দিন অনুভব করেন যে, তিনি একজন বিজয়ী।
তিনি প্রমাণ করেন, নিজের লোভলালসা, কামনাবাসনার ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপে তিনি সক্ষম; যথাযথ আত্মনিয়ন্ত্রণ তার দ্বারা সম্ভব এবং সুশৃঙ্খল জীবনের স্বাদ পেয়েছেন। এটা তার শ্রেষ্ঠতম বিজয়। কারণ, যিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণের উপায় এবং কামনাকে নিয়মের আওতায় আনতে জানেন, তিনি পাপ ও মন্দকাজ, ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা, অন্যায়-অশালীনতা, ঈর্ষা ও লালসা এবং মানুষ দাসত্ব করে এমন অন্যান্য দোষ ও দুর্বৃত্তপনা থেকে মুক্ত। ঈদের দিনটা এই মুক্তিরূপী পরম সাফল্যই নির্দেশ করে। সে দিন ওই বিশ্বাসী তার সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় উদযাপন করে থাকেন।
ইসলামের দিবস: ঈদুল ফিতরের সত্যিকার তাৎপর্য হলো, এটা একাধারে শান্তি ও কৃতজ্ঞতা, ক্ষমা ও নৈতিক বিজয়, পুণ্য অর্জন ও প্রকৃত সাফল্য, স্মরণ ও নির্মল উৎসবের অনন্য একটি দিবস। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পালিত ঈদের এসব কিছুর সম্মিলন ঘটে এবং থাকে এর বাইরে আরো কিছু।
মুনাজাত করি সত্য আসলে কী, তা চেনার পথ যেন আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রদর্শন করেন। তিনি যেন সে পথ অনুসরণের তৌফিক দেন। আল্লাহ যেন মিথ্যাকে চেনার সামর্থ্য এবং তা থেকে দূরে থাকার দৃঢ় ইচ্ছা আমাদের দান করেন, সে জন্যও প্রার্থনা করছি।
পরিশেষে বলতে চাই ঈদের শিক্ষা হলো সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মবোধের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার সম্প্রসারণ।