শিক্ষার উন্নয়নে প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ

ড. কে এম আতিকুর রহমান
ড. কে এম আতিকুর রহমান  © টিডিসি ফটো

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুই ধরনের লোকবল থাকে— প্রশাসনিক ও একাডেমিক। শিক্ষকমণ্ডলী শ্রেণি কার্যক্রম ও সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কর্মচারীবৃন্দ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রশাসন পরিচালনা করে থাকেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হলো— শিক্ষাদান, শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা। আর এ কাজকে সহজতর করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনের। 

কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে এর উল্টো চিত্র লক্ষণীয়। মনে হচ্ছে প্রশাসনের উন্নয়ন বা সুবিধার জন্যই শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্তমানে পরিণত হয়েছে অনুষ্ঠান সর্বস্ব, পরীক্ষা কেন্দ্র, টাকা-পয়সার হিসাব-নিকাশ পরিচালনা, একে অপরকে ম্যানেজ করে চলা, লেজুড়বৃত্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে। এতে শিক্ষাদান ও গবেষণা হয়ে পড়েছে দ্বিতীয় শ্রেণির এসাইনমেন্টে। এ কাজ আরো সহজ করে দেওয়া হয়েছে সহজে ফরমপূরণ, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও সহজে পাস করার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। তাই শিক্ষার্থীদের পক্ষ হতে শিক্ষা প্রশাসনের ওপর নেই কোন চাপ।

প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোটি টাকার তহবিল জমা থাকে। বিধি-বিধানের মাধ্যমে প্রায় ২০টির অধিক খাতে শিক্ষার্থীদের নিকট হতে বড় অঙ্কের অর্থ ফান্ডে জমা হতে থাকে। ভর্তি ও ফরমপূরণের মাধ্যমেই এই অর্থ শিক্ষার্থীরা প্রদান করে থাকেন। টাকা জমাদানের রশিদে উল্লেখ থাকে না কোন খাতে কত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ভর্তি ও ফরম পূরণের জন্য ফির পরিমাণ সংবলিত যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে গোপনীয়ভাবে প্রকাশ করা হয়। শিক্ষার্থীরা মনে করে এটাই নিয়ম ও নিয়তি। 

অন্যদিকে এই আদায়কৃত অর্থ কোন কোন খাতে, কখন ও কি পরিমাণ ব্যয় করা হলো তাও শিক্ষার্থীদের বা শিক্ষকদের পুরোপুরি জানার সুযোগ থাকে না। প্রতি ৩/৪ বছরে হয়ত একবার সরকারি অডিট হয়ে থাকে যা প্রতিবছরই হওয়ার কথা। আবার অভ্যন্তরীণ একটি অডিট কমিটি থাকে যা নামেমাত্র। এই কমিটি কদাচিৎ নামকাওয়াস্তে অডিট প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান যেভাবে চেয়ে থাকেন এটা সেইভাবেই হয়ে থাকে। এই প্রতিবেদন কোনদিনই শিক্ষার্থী বা অভিভাবকগণ জানতে পারেন না। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এই প্রথা কম-বেশি চালু রয়েছে। অথচ আয়-ব্যয়ের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করাই হচ্ছে স্বচ্ছতা।

৩/৪ বছরে যে একটি সরকারি অডিট হয়ে থাকে সেখানেও আন্ডারহ্যান্ড লেনদেনের ব্যাপারে সমাজে জনশ্রুতি রয়েছে। লেনদেন ভাল হলে অডিটরগণও ‘ক্লিন শীট’ দেন ভালোভাবে। সুতরাং ঐ অডিট কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় না বরং ঘোলাটে হয়। ভিকটিম হচ্ছে কেবল শিক্ষার্থীদের অসহায় মা-বাবা। এই অস্বচ্ছভাবে অর্জিত অর্থ অনেক প্রশাসনের সন্তানদের মানুষ করার কাজে ব্যয় হয়। অনেকে তাদের সন্তানদেরকে পাঠিয়ে দেন বিদেশের মাটিতে। ফলে তাদেরকে এই অস্বচ্ছতার কুফল স্পর্শ করতে পারে না। টাকা থাকার ফলে প্রভাবশালীদের সঙ্গে তাদের নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। তাদের বসবাস হয় নিরাপদ জোনে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের সমস্যা হয় না; কারণ তারা প্রভাবশালী নেটওয়ার্কের সদস্য।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন ফান্ড নামে একটি ফান্ড থাকে। মাঝারি মানের একটি প্রতিষ্ঠানে এই তহবিল ব্যবহার করে ছোট ছোট সংস্কার বা উন্নয়নমূলক কাজ নিয়মিতভাবেই করা সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রশাসন খুব কম ক্ষেত্রেই এই অর্থ ব্যয় করে। সরকারি কোন বাজেট আসলেই কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ দৃশ্যমান হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ফান্ডের আয়-ব্যয়ের হিসাব সৃষ্টিকর্তা ছাড়া জানা সম্ভব হয় না বললেই চলে। 

আর এজন্যই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন, ক্যাম্পাস ও ক্লাসরুমের দিকে তাকালে মনে হয় এগুলো অনেক আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে অথবা দেখার কোন কর্তৃপক্ষ আছে বলেও মনে হয় না। শিক্ষার্থী ও সমাজের মানুষ মনে করে এটাই নিয়ম ও নিয়তি। অথচ ক্যান্টনমেন্টের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে মনে হবে আমরা ইউরোপের কোন রাষ্ট্রে আছি। হ্যাঁ, তাদের আয়টা বেশি, কিন্তু তাদের সদিচ্ছা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতাটাও বেশি।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নানা সময়ে নানাভাবে শিক্ষার্থীদের নিকট হতে রশিদ ছাড়া টাকা আদায় একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কিন্ডারগার্টেন সর্বত্রই চলছে এই প্র্যাকটিস। রেজিস্ট্রেশন কার্ড, এডমিট কার্ড, প্রত্যয়নপত্র ও প্রশংসাপত্র অর্থাৎ যেকোনো কাগজপত্র গ্রহণের সময়েই শিক্ষার্থীকে গুনতে হয় টাকা। প্রতিষ্ঠান প্রশাসনের যোগসাজেশেই কর্মচারীবৃন্দ এগুলো করে থাকেন। 

বলা হয়ে থাকে, এগুলোর জন্য শ্রম আছে, খরচ আছে তাই তোমাদের কাছ থেকে এগুলো নিতে হয়। এগুলোর জন্য খরচ আছে তার জন্যে ভর্তির সময়েই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি নেওয়া হয়। প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আছে এগুলো করার জন্য একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে থাকে প্রশাসন, কর্মচারী, কিছু শিক্ষক (সবসময় নয়) ও অন্যান্য কিছু প্রভাবশালী লোক। শিক্ষকরা বা অন্যান্যরা ভয় পেয়ে হাত পা গুটিয়ে রাখেন নিজেদের ক্ষতি অবস্থানের ক্ষতি হবে ভেবে।

এভাবেই চলছে আমাদের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই ঘূর্ণিচক্রের মাঝে শ্রেণি কার্যক্রম হয়ে পড়েছে গৌণ কাজ। এসব দেখে ভাল শিক্ষকরাও ডিমোরালাইজড হয়ে পড়ছেন। তারাও শ্রেণি কার্যক্রমে ভাল পারফর্ম করতে পারছেন না। ফলে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়েছে সনদ বিক্রি, বেকার তৈরি ও সৃজনহীনতার কারখানা। এই দুষ্টচক্রের অচলায়তন ভাঙ্গবে কে? এই অচলায়তন ভাঙার জন্য যে সাহস, বুদ্ধিমত্তা, নীতিবান মানুষ বা শিক্ষক দরকার তার সংখ্যাটাও এই চক্রের মারপ্যাঁচে হ্রাস পাচ্ছে।

প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে একটি ক্রয় কমিটি। এই ক্রয় কমিটি প্রশাসন ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার হাতের পুতুল হিসেবেই কাজ করে থাকে। কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখাই এদের কাজ। কত টাকা আছে, কোন সামগ্রী কেনা হলো অথবা হলো না তার কোন বালাই নেই। এর হিসাব জানারও কোন উপায় নেই। একটি সময়ে প্রতিষ্ঠান প্রধান হওয়ার জন্য তেমন কোন তদবির প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এই পদগুলো সোনার হরিণের মতই মূল্যবান। সবাই যেতে চায় এ চেয়ারে। কারণ চেয়ারগুলো হীরকখচিত পদের ধারক। তিন থেকে পাঁচ বছরেই এ চেয়ার একজনকে মধুময় করে তোলে।

আমাদের শিক্ষক সমাজের পদায়ন, পদোন্নতি,  জীবনমানের উন্নয়ন ও শিক্ষার উন্নয়নের জন্য প্রথমে আমাদের নিজেদের উন্নয়ন প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। শিক্ষা প্রশাসন তথা আমাদের স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতা যখন বৃদ্ধি পাবে তখন আমাদের ঐক্যও বৃদ্ধি পাবে। বাড়বে আমাদের সক্ষমতা ও ভয়েজ। 

এ পর্যায়ে আমাদের কেউ আটকাতে পারবে বলে মনে হয় না। আমাদের দুর্বলতাকে পুঁজি করেই মনে হয় অন্যরা আমাদের নিয়ে খেলছে অথবা অন্যদেরকে আমরা পক্ষে টানতে পারছি না। ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে পড়ে থাকলে পুরো শিক্ষক সমাজ আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। আমরা যদি সামষ্টিক স্বার্থে, শিক্ষার স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করি এবং আমাদের কাজে যদি দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে পারি তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাদের সংকট দূরীভূত হবে বলে মনে করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।


সর্বশেষ সংবাদ