স্বাধীনতা শব্দটি যেভাবে আমাদের সম্পদে পরিণত হয়েছিলো

এ.কিউ.এম সিফাতুল্লাহ
এ.কিউ.এম সিফাতুল্লাহ  © সংগৃহীত

‘স্বাধীনতা’ শব্দটির তাৎপর্য সীমাহীন।কোন স্কেল দিয়ে এই শব্দের গভীরতা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা অরণ্যে রোদন হবে। স্বাভাবিক ভাবে এর অর্থ অন্যের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি এবং নিজের মনমতো করে যাবতীয় কিছু উপভোগ করা। এক বাক্যে বলতে গেলে অন্যের অযাচিত হস্তক্ষেপবিহীন যাবতীয় কিছু পরিচালনা ব্যবস্থাই হলো স্বাধীনতা। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা ছাড়া সর্বোচ্চ আউটকাম পাওয়া সম্ভব নয়। সামগ্রিক বিকাশের জন্য স্বাধীনতার বিকল্প কিছু আছে বলে মনে হয় না। 

আর এই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি যখন একটি ভূখণ্ডের মাথা উঁচু করে বাঁচবার প্রশ্নে এসে দাঁড়ায় তখন এর ব্যাপ্তি হয় অনেক একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতা মোটাদাগে বলতে গেলে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি স্বাধীনতাকেই বোঝায়। 

বৃটিশদের সাথে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জিন্নাহ’র দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত পৃথক স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করা হয় যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের মানচিত্রে দুইটি আলাদা অঞ্চল অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তান আর অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। 

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলা তথা বর্তমান বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে এক পশ্চাৎপদ অঞ্চল হিসেবে।  অবকাঠামো, যোগাযোগ, আর্থিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, প্রতিরক্ষা সকল ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা ছিল যে, পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্যের চেতনা উভয় অঞ্চলের মধ্যে সমতা বিধান করতে সক্ষম হবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ অনুধাবন করতে শুরু করল যে, তারা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সমান গুরুত্ব পাচ্ছে না। তখন থেকে বিপত্তির সূচনা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান সবক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানের উপরে বৈষম্যের স্টিম রোলার চালাতে শুরু করে। 

দেশবিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম নগ্ন হস্তক্ষেপ ছিল আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষার উপরে। ওদের ডিমান্ড ছিল উর্দু হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু তা এই ভূখণ্ডের অকুতোভয়ী ছাত্র জনতার সংগ্রামের মুখে সালাম, জব্বার,রফিক,শফিক প্রমুখদের তাজা রক্তের বিনিময়ে ওদের সেই এজেন্ডা বাস্তবায়ন হয়নি। 

এর পরেই পূর্ব বাংলার মানুষ সচেতন হতে শুরু করে।পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা অনবরত রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা,সংস্কৃতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়ন মূলক নীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। এরই ফলস্বরূপ পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে স্বাধীনতা ক্ষুধা জাগ্রত হয় এবং তা আদায় করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের পর, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭০’র সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল সবই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ঘৃণার বহি:প্রকাশ। 

সমস্ত কিছু সহ্য করতে করতে যখন এই ভূখণ্ডের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিলো তখন তারা ‘হয় বাঁচবো নয় মরবো’ এই নীতিতে স্থির হয়েছিলো। আর তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক মহাসমাবেশের ডাক দেন। যা মহাসমুদ্রে পরিণত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু তার ১৮ মিনিটের বক্তব্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত অন্যায়, অবিচারের কথা তুলে ধরেন এবং স্পষ্টই জানিয়ে দেন এভাবে চলতে থাকলে পূর্ব বাংলার ৭ কোটি মানুষ আর সহ্য করবে না। তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেই। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর সর্ব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে নবপ্রাণের উদয় হয়।

যা আঁচ করতে পেরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা ২৫ মার্চের গভীর রাত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। গভীর রাতে জাতির জনকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ঘোষণাটি ছিল ইংরেজিতে যাতে করে বিশ্ববাসীর কাছে বোধগম্য হয়। ঘোষণাটি ছিল :

‘ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে,যাহার যা কিছু আছে তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও। সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।’

এর দীর্ঘ নয় মাসের ইতিহাস এক করুণ ইতিহাস। এদেশীয় রাজাকার, আলবদর -আলশামসের সহযোগিতায় সর্বত্র অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটে মেতে ওঠে হায়েনাদের দল। কিন্তু স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের স্বাধীনতার প্রত্যয়, সীমাহীন তেজ ও একাগ্রতায় ৩০ লক্ষ শহিদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি এবং পৃথিবীর মানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকা স্থান করে নেয়।

এত কিছুর পরেও যেন এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতাকামী মানুষ স্বাধীনতার পরিপূর্ণ স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। কারণ, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। সর্বশেষ ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১০ই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। সেইদিন থেকেই বাংলার আকাশ -বাতাসে স্বাধীনতার রং ছড়াতে শুরু করেছিলো। 

আমরা সকলেই জানি, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন!’ সুতরাং আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো দেশের স্বার্থকে ব্যাক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে সমাস্ত দায়িত্ব বুঝে নেয়া এবং তা যথাযথ পালন করা। আমরা আমাদের সততা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে লাল সবুজের মান উজ্জ্বল করবো এই হোক এবারের স্বাধীনতা দিবসের প্রত্যয়।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence